প্রতারণার দৌরাত্ম্যে আশঙ্কিত সমগ্র জনগণ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোন জাতিরাষ্ট্রই দুর্নীতিপ্রতারণার নানামুখী প্রকরণমুক্ত নয়। এসব অপাংক্তেয়অনভিপ্রেত প্রত্যয়ের যথেচ্ছাচার এবং চলমান ঘটনাসমূহের ইতিবৃত্ত দেশবাসী প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যম সূত্রে সম্যক অবগত হচ্ছেন। দেশব্যাপী বহুমাত্রিক কুৎসিত জালিয়াতিমিথ্যাচারকদাচারঅরাজকতাসহ প্রতারণামূলক অপরাধ সর্বত্রই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে চলছে। সমগ্র জনগণ এতে ভীষণ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সর্বনিম্ন থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানব্যাংকবীমাপুঁজিবাজারআবাসন প্রকল্পসরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদপদায়ন, ভর্তিনিয়োগটেন্ডার বাণিজ্যসহ এমন কোনো কর্মযজ্ঞ নেই যাতে অধিকাংশ সংস্থাজনগোষ্ঠী কোন না কোনভাবে প্রতারণাজালিয়াতির শিকারে নিপতিত হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে সর্বস্ব হারিয়ে, মানমর্যাদা সুরক্ষায় প্রায় দেউলিয়ার মুখোমুখি বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মানুষ। যদিও জনশ্রুতি ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকঅনানুষ্ঠানিক গণমাধ্যম সূত্র থেকে এসব প্রতারকজালিয়াত চক্রের পৃষ্ঠপোষকদের পরিচিতি স্ব স্ব অঞ্চলে কমবেশি সবারই জানা; অদৃশ্য কারণে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ যেন সুদূর পরাহত। চিহ্নিত নাগনাগিনীরা ছলচাতুরীঅভিনয়শৈলীলবিং তদবির বাণিজ্যঅর্থলিপ্সু অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে অপাংক্তেয়অযাচিত এসব কদর্য কর্মকান্ড অব্যাহত রেখে দেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার বিষয়। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থআরোপিত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির আগ্রাসনে এরা এত বেশি শক্তিশালী; সৎযোগ্যদক্ষমেধাবীদেশপ্রেমিক সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে এদের প্রতিরোধ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিঘুষনির্লজ্জ নগদ অর্থ লেনদেনে সকল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অশুভবলয়ে সংঘটিত জঘন্য অপরাধ কর্মে জড়িতনেতৃত্বে রয়েছে অন্ধকারের পূজারী অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু দানবরূপী মাফিয়া চক্র। ‘ম্যানেজ’ অপসংস্কৃতির নগ্নতায় এদের আগ্রাসী কুপদচারণা সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযানে সময়ের ব্যবধানে কিছুটা স্থিতিমিত হলেও; স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার তারা এতবেশি অদমনীয় শক্তিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী ডিজিটাল, অ্যানালগসহ নানা প্রতারণার বেড়াজালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতারণার বহুমাত্রিকতায় সকল স্থানে নিরাপদে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ ডিজিটাল দুনিয়ার বৃহৎ অংশ জুড়েই ওৎ পেতে আছে বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদ। ডিজিটাল প্রতারণার পর্বতসম অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট। বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্লাটফর্ম কেন্দ্রিক। বিজ্ঞজনদের মতে, দেশে প্রতারণামূলক অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সমাজে সুদূর অতীতকাল থেকে প্রতারণামূলক অপরাধ বিরাজ করলেও; নতুন নতুন কৌশলের আবির্ভাবে প্রতারণামূলক অপরাধ নতুন মাত্রিকতা পেয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে এর মাত্রা বেড়েছে আরো বহুগুণ। পূর্বে প্রতারকচক্র মানুষের অসচেতনতার সুযোগে সাধারণের আস্থা অর্জন করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিলেও; তা ছিল সামান্য বা কিছু পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের অপরাধের শিকার হত একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিপেশার মানুষ। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং চাওয়াপাওয়ার স্বল্পতার কারণে সহজে কোনো কিছু অর্জন করা থেকে নিজেকে দূরে রাখত। কিন্তু অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির উত্থান এবং অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি মানুষের জীবনধারণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজন বহির্ভূত উচ্চাভিলাষের বশবর্তীতায় অপ্রয়োজনীয় অনেক চিন্তাচেতনা পরিলক্ষিত। এই সুযোগে প্রতারকচক্র আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে আবার অনেকে অল্পে রক্ষা পাচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতারণার সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতারকদের নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিক্ষিতঅশিক্ষত অনেকেই কপুকাত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার চাকরিজীবীরাও এদের কদর্য প্রতারণার শিকার। ভুক্তভোগীরা প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হলে প্রতারণার ভয়ঙ্কর কৌশলসমূহ কদাচিৎ জনসম্মুক্ষে উন্মোচিত হয়। ব্যাংকিং সেক্টরে অনলাইনের প্রসারের সাথে সাথে জালিয়াতি ও প্রতারণার ব্যাপকতাও বাড়ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেওয়ার কথা বলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়। ইতিমধ্যে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন এজেন্টের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

২০২৩ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিগ্রামে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিক্রি এবং এসব তথ্য দিয়েই ব্যাংকের কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নামে নানান প্রতারণামূলক ব্যবসার ছড়াছড়ি অতিশয় দৃশ্যমান। ভুয়া তথ্যের এসব ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সক্রিয় রয়েছে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ শক্তিশালী একটি অসাধু চক্র। তথ্য বিক্রি বাড়াতে দেশের প্রতিষ্ঠিত মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকটি ব্যাংকের নামও ব্যবহার করে কৌশলে গ্রাহকদের ধোঁকা দেয়ার এই ব্যবসা চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তথ্য প্রযুক্তিবিদদের মতানুসারে, যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে এমনিতেই মানুষ এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছে; এখন তাদেরকে বিভ্রান্ত করাটা আগের চেয়ে সহজ। ফলে সত্যমিথ্যা নানান রকম কথা বলে সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ ব্যবসা করে থাকতে পারে। এ ধরনের তথ্য যারা অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করছে এবং প্রলোভনে পড়ে যারা কিনছে, উভয়েই সমান অপরাধী। কাজেই যারা এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এলে শাস্তির সম্মুখীন হবে। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, এমন তথ্য কিনে কখনোই টাকা পাওয়ার কোন সুযোগ বাংলাদেশে নেই।

চলতি বছরের মে মাসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে সম্প্রতি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংস্থাটির নাম ব্যবহার করে সংঘটিত প্রতারণামূলক কার্যকলাপ নিয়ে সতর্কতা জারি করে এ ধরনের ভুয়া প্রস্তাব ও বার্তা সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সতর্ক বার্তায় উল্লেখ করা হয় যে, প্রতারকরা জাইকার নাম ও লগো ব্যবহার করে ভুয়া সঞ্চয় প্রকল্প, ঋণ সুবিধা ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এসব প্রতারণামূলক কার্যক্রমের ভুয়া দাবির মধ্যে রয়েছেজাইকা প্রদত্ত ব্যক্তিগত ঋণ সুবিধা এবং এক্ষেত্রে অগ্রিম অর্থ ও অনেকক্ষেত্রে প্রক্রিয়াকরণ ফিও দাবি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি কিছু ফেসবুক পোস্টে জাইকার নাম ব্যবহার করে ভুয়া সঞ্চয় প্রকল্প ও চাকরির বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে। একই মাসে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও প্রতারক চক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য পরিচয়ে এবং বিভিন্ন পুলিশ কর্মতর্কার নাম ও ছবি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিগত মাসেও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতারণামূলক ফাঁদ থেকে নিরাপদ থাকতে অধিকতর সাবধানতা অবলম্বন বিষয়ে সাতটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতিজালিয়াতিপ্রতারণার ব্যাপকতা সমাজের এতবেশি গভীরে প্রোথিত হয়েছে; তা সমূলে উৎপাটন করা না গেলে জাতির সকল উন্নয়নঅর্জন বিশ্বপরিমন্ডলে উঁচুমাত্রিকতার ভাবমূর্তি ধ্বসে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা প্রবল। প্রতারণা ও জালিয়াতিকে প্রতিরোধ করার দৃঢ়চেতানির্ভীকসাহসিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই দেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেই। যথোপযুক্ত বস্তুসত্যনিষ্ঠন্যায়পরায়নতায় উঁচুমার্গের ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে নৈর্ব্যক্তিক পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনে সংঘটিত কর্মযজ্ঞে অভিযুক্তদের বিচারিক আদালতে প্রমাণিত অপরাধের শাস্তির চূড়ান্ত ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টির অশুভ প্রচেষ্টার বিনাশ এবং সকল অপশক্তির ঘৃণ্য কুপরিকল্পনা নিধন করার জন্য শুভসুন্দরকল্যাণময়ী শক্তির একতা দেশ রক্ষার যুদ্ধে অপরিমেয় ব্রত ও চূড়ান্ত বিজয়ের অনবদ্য দৃষ্টান্ত নির্মাণে অত্যুজ্জ্বল হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজঅপরাধবিজ্ঞানী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধ‘আউলিয়াদের নিরলস ত্যাগের বিনিমিয়ে ইসলামের সুবিশাল ইমারত বিনির্মিত’