প্রজ্ঞা ছিল ছোট্ট এক বাচ্চা মেয়ে, যার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত নরম তুলতুলে বিড়াল ছানাদের আদর করতে। ছোট মামা বিড়াল পুষতেন। নানুর বাসায় গেলে তুলতুলে বিড়ালটাও প্রজ্ঞার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করত। আদর করে কোলে তুলে নিলে একেবারে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকতো। কি যে ভালো লাগতো প্রজ্ঞার। কতবার বাসায় বিড়াল পুষতে চেয়েছে, কিন্তু তার বাবা–মা একেবারেই রাজি ছিলেন না। তারা বলতেন, “বিড়াল মানেই নোংরা, দুষ্টুমি আর আস্ত একটা ঝামেলা!”
কিন্তু ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলা! একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রজ্ঞা রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট বিড়াল ছানা দেখতে পেল। ছানাটি অনবরত মিউমিউ করে ডেকেই যাচ্ছিল। ওটা এত ছোট আর অসহায় ছিল যে প্রজ্ঞার মনটা মায়ায় ভরে গেল। সে আশেপাশে তাকিয়ে আর কোন বিড়াল দেখতে পেলো না। কৌতূহল নিয়ে কাছে যেতেই বিড়ালছানাটা সরাসরি তার পায়ের ওপর লাফ দিয়ে উঠে বসল!
“বাহ! তুমি তো দেখি ভয় পাও না!” প্রজ্ঞা অবাক হয়ে বলল।
“মিউ!” বিড়ালছানাটা উত্তর দিল, যেন বলতে চাইছে, “আমার বাড়ি নেই, আমাকে নিয়ে যাও! আমি হারিয়ে গেছি।“
প্রজ্ঞা আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। স্কুলব্যাগের ভেতর বিড়ালছানাটাকে লুকিয়ে বাসায় নিয়ে এল। নাম দিল “মিষ্টি“। কারণ ও ছিল একদম তুলতুলে মিষ্টির মতো নরম! আর এই নামের মতোই সে ছিল দেখতে ভীষণ মিষ্টি, দুরন্ত আর খানিকটা ব্যতিক্রমী।
প্রজ্ঞার সমস্যা শুরু হলো রাতে। মিষ্টিকে লুকিয়ে রাখার প্ল্যান করেছিল সে, কিন্তু বিড়ালছানার কি আর চুপচাপ থাকার ইচ্ছে আছে? রাতের বেলা হঠাৎ মিউ… মিউউউ! করে একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল!
প্রজ্ঞার মা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বললেন, “এত শব্দ কিসের?”
প্রজ্ঞা তাড়াতাড়ি কম্বলের নিচে মিষ্টিকে লুকিয়ে ফেলল।
“কিছু না মা, আমি গান গাচ্ছিলাম।”
“এ কেমন গান? বিড়ালের মতো শোনাচ্ছে!” মা সন্দেহের চোখে তাকালেন।
“উমম… নতুন স্টাইল মা!”
কিন্তু মিষ্টির চুপ থাকার মোটেই ইচ্ছে ছিল না! সে খপ্ করে প্রজ্ঞার পায়ের আঙুল কামড়ে ধরল।
“আহ!” প্রজ্ঞা চিৎকার করে উঠল।
মা তখনই কম্বল টেনে ধরলেন। মিষ্টিও সুযোগ বুঝে একলাফে পড়ার টেবিলের নিচে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখতে লাগল। মা ও কিছুক্ষণ মিষ্টির চোখে চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,
“ওহ! তো তুমি লুকিয়ে বাসায় বিড়াল এনেছো!”
মার মুখে রাগ থাকলেও চোখে হাসির আভাস ছড়িয়ে ছিল।
প্রজ্ঞা চোখ বড় বড় করে বলল, “উমম… এটা একটা বিশেষ বিড়াল মা! এটা আমার ভাগ্য বিড়াল! এটা থাকলে নাকি পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়া যায়!”
বাবা পাশে এসে বললেন, “ও তাই নাকি? তা এই বিড়ালটা কি অংক কষে দিতে পারবে?”
প্রজ্ঞা বুঝল, তার অভিনয় কাজ করছে না। সে মন খারাপ করে মাথা নিচু করল। মৃদু স্বরে বলল, “আমাকে যা ইচ্ছে বলো, কিন্তু মিষ্টিকে বের করে দিও না প্লিজ!”
মা–বাবা একে অপরের দিকে তাকালেন। তারপর মা মুচকি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, মিষ্টিকে রাখা যাবে। তবে শর্ত একটাই, সব দায়িত্ব তোমার!”
প্রজ্ঞা উচ্ছ্বাসে মিষ্টিকে কোলে তুলে নিল। “থ্যাঙ্ক ইউ মা! আমি সবসময় ওর খেয়াল রাখবো!”
সেই রাত থেকেই মিষ্টি হয়ে গেল প্রজ্ঞার পরিবারের এক সদস্য। বিড়ালছানার জন্য মা নিজেই দুধ এনে দিলেন, বাবা মিষ্টির জন্য একটা ছোট্ট বিছানা বানিয়ে দিলেন। আর প্রজ্ঞা প্রতিদিন ওকে আদর করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগল।
দিন শেষে, মিষ্টির প্রতিটি দুরন্তপনা প্রজ্ঞার মুখে হাসি এনে দেয়। তাদের ভালোবাসা এমনই, যেখানে হাসি, আবেগ আর আনন্দ মিলে তৈরি হয় এক অসাধারণ গল্প। মিষ্টি শুধু প্রজ্ঞার বিড়াল ছিল না; সে ছিল তার প্রাত্যহিক জীবনের হাসি আর আনন্দের সবচেয়ে প্রিয় অনুভূতি।
আর মজার ব্যাপার কী জানো? যেই দিন থেকে মিষ্টি বাসায় এল, প্রজ্ঞার পরীক্ষার রেজাল্টও ভালো হতে শুরু করল!
মা মজা করে বলতেন, “তোর ভাগ্য বিড়াল তো সত্যিই কাজ করছে!”
প্রজ্ঞা খিলখিল করে হেসে বলত, “আমার নাকি মিষ্টির ভাগ্য, যে ও আমাকে পেয়েছে?”