প্রজন্মের ভাবনা-সংঘাত

জেসমীন আরা জেসী | রবিবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

গেল, গেল দেশটা রসাতলে গেল। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের এত অধঃপতন! তারা কোনো কথা শুনে না, বড়দের মানতে চায় না, সম্মান করে না, সারাদিন লেখাপড়া করে না, রাত জেগে পড়ে। আবার এই প্রযুক্তিও তাদের শেষ করে দিচ্ছে, সারাদিন মোবাইল, ট্যাবসহ বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। আমাদের যুগে আমরা কত কত নোট করে বা লিখে পড়াশোনা করেছি। আর এখনকার ছেলে-মেয়েরা এসবের ধারে কাছেও নাই। আমরা এত জোরে জোরে পড়তাম আশেপাশের প্রতিবেশিরাও বুঝতো আমরা লেখাপড়ায় কত মনোযোগী ছিলাম। আর এখনকার ছেলে-মেয়েদের মুখ থেকে পড়ার কোনো শব্দও শোনা যায় না, শুধু চোখ পাকিয়ে দেখে থাকে বইয়ের দিকে। মোট কথা, তখনকার মানুষজন অতি অতি ভাল ছিল সবকিছুতে আর এখনকার ছেলে-মেয়ে সব রসাতলে গেছে।
প্রায় আমরা শিক্ষকরা বলে থাকি, আমাদের সময়ের ছেলেমেয়েরা ক্লাসে কত মনোযোগী ছিলাম! শিক্ষক ক্লাসে এলে ভয়ে সব একেবারে চুপ। সগর্বে অনেক শিক্ষকই বলেন, আমি ক্লাসে ঢুকলে একেবারে পিনপতন নীরবতা। এর মধ্যে কেউ দুষ্টামি করলেই বেত্রাঘাত। ব্যস সব ঠিকঠাক। আর এখনকার ছেলেমেয়েদের ক্লাসে কোন মনোযোগই নাই। হৈ চৈ করে, দুষ্টামি করে ইত্যাদি ইত্যাদি, এখন আবার শারীরিক শাস্তিও নিষেধ।
এবার আসুন ব্যাপারগুলো একটু খেয়াল করি।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের পার্থক্য হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের ভাবনার সাথে এই প্রজন্মের ভাবনার, মানসিকতার পার্থক্য ঘটবে.. তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরঞ্চ আমরাই অস্বাভাবিক আচরণ করি… আমাদেরই মন-মানসিকতার আর মেনে নেওয়াতে সমস্যা, সমস্যা আমাদের নতুনের ভাবনায়, পরিস্থিতিতে অভিযোজিত হওয়ার। যুগে যুগে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়ে আসছে, পরিবর্তন হবে। সেটা আচরণগত হোক আর শিক্ষার ক্ষেত্রেই হোক।
নতুন প্রজন্মের মানসিকতার সাথে আমাদের মানসিকতা, ভাবনাকে এক করে ফেললেতো হবে না, সেটা নির্বুদ্ধিতারই সামিল হবে। পৃথিবীর কোন ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসছে না? ফসল উৎপাদন, খাদ্যাভ্যাস, বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ সর্বক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে, আসছে। এভাবে বিভিন্ন আবিষ্কারেও এসেছে ভিন্নতা। শুরুতে মানুষ সূর্যের অবস্থান দেখে সময় নির্ণয় করতো,লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ করতো, পাখি দিয়ে চিঠিপত্র আদান প্রদান করতো, আরো নানান কাজকর্ম করতো।
কিন্তু সূর্যের আলোর পরিবর্তে আমরা যেমন সহজে ঘড়িকে গ্রহণ করেছি,লাঙ্গলের পরিবর্তে ট্রাক্টর বা উন্নত যন্ত্রকে গ্রহণ করেছি.. সেভাবে প্রজন্মের মানসিকতার ধরণ পরিবর্তনকে কিন্তু গ্রহণ করতে পারিনা।
আগে আমাদের গুরুজনেরা বলতেন, এটা করিও না, এটা করা খুব খারাপ, ব্যস আমরা বিনা বাক্যে, বিনা প্রশ্নে সেটা আর করতাম না। আর এখনকার প্রজন্ম প্রশ্ন করে জানতে চায় ওটা কেন করব না, ওটার পেছনে যুক্তি খুঁজে তারা। আমরা তাতেই বলি, তারা মুখে মুখে তর্ক করে। বড়দের সম্মান করে না। কিন্তু একটু ভেবে দেখেন তো, কোনটা সঠিক?
জেনে না করা আর না জেনে না করার মধ্যে কোনটা ভাল, কোনটা বেশি হৃদয়োঙ্গম হবে। ক্লাসে পিনপতন নীরবতা কি বাহবা পাবে না কি শিক্ষার্থীর কৌতূহল, একটু জানার আগ্রহ সেটা বাহবাযোগ্য? আমি ক্লাস নিচ্ছি, সবাই বেত্রাঘাতের ভয়ে চুপ, আমি শান্তিমত পড়া আওড়িয়ে আসলাম, শিক্ষার্থী বুঝল কি বুঝল না তা না জেনেই চলে আসলাম।
বাঃ শিক্ষার্থীরা তো বেশ চুপচাপ ছিল, তারা খুব ভাল।
কিন্তু আসলেই কি তাই?
আমরা সারাক্ষণ অভিযোগ করি তারা ক্লাসে মনোযোগী না। কিন্তু তার পেছনে যথেষ্ট কারণ কি নেই? সত্যি কথা হলো এখনকার প্রজন্ম অনেক এগিয়ে। পুরনো ধ্যান, ধারণা, পদ্ধতি দিয়ে তাকে পড়াতে বা শেখাতে গেলে সে কখনোই ক্লাসে মনোযোগী হবে না।কারণ সে পদ্ধতিটা তাকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। আমি, আপনি তার চিন্তাভাবনা, প্রতিভা, জ্ঞানের চাহিদা থেকে অনেক পিছিয়ে। তাহলে সে আমার, আপনার কথা শুনবে কেন?
আসলে আমরাই প্রজন্মের মানসিকতার সাথে তাল মেলাতে পারছি না, এটা আমাদের ব্যর্থতা।
হ্যাঁ, নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভালো-মন্দ বোঝানোসহ বিভিন্ন নৈতিকতামূলক মানবিক গুণগুলোর বীজ আমাদেরকেই বপন করতে হবে, পরিচর্যা করতে হবে… এই দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কিন্তু সেটা অবশ্যই ভয় দেখিয়ে নয়, হৃদয়গ্রাহী করে, তাকে পালনে বাধ্য করে নয়, হৃদয়ে ধারণের ব্যবস্থা করে। বেত্রাঘাত করা সেখানে কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই আসুন, নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ না করে আমরা একটু নিজেদের পরিবর্তনের চেষ্টা করি, পরিবর্তন করি মানসিকতার।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়াবী প্রতিটি প্রহর
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে