অধ্যাপক ড. মইনদ্দীন আহমদ খান। যাঁকে সংক্ষেপে আমরা ‘খান স্যার’ বলে জানতাম। অবয়ব ও বাচনভঙ্গি দেখলেই মনে হতো স্যার সহজ সরল আন্তরিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্টের একজন মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই স্যারকে দেখতে পাই তিনি ইসলামের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান। তখনকার দিনে বিভাগের জ্ঞানবৃদ্ধ শিক্ষকটিই বিভাগের চেয়ারম্যান থাকতেন। এখনকার মতো দু‘বছর পর পর পালাক্রমে বা ঘূর্ণন পদ্ধতিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার প্রথা চালু ছিল না। যেমন ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করা প্রথম চারজন শিক্ষকের একজন ড. আবদুল করিম স্যারকে শুরু থেকেই ১৯৭৫ সালে উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান থাকতে দেখেছি। তেমনি ছিলেন ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ আলী স্যারসহ অন্যান্য স্যাররাও। আমি ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলাম। যাকে ‘জেনারেল হিষ্ট্রি’ বিভাগ বলা হয়। ইতিহাস বিভাগ ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অবস্থান আর্টস্ ফ্যাকাল্টি অর্থাৎ বর্তমানে ড. আবদুল করিম ভবনের যথাক্রমে ৩য় ও ৪র্থ তলায় সিড়ির পাশে ঠিক উপরে নীচে। সেই সুবাদে খাঁন স্যার তখন থেকেই আমাদের অতি কাছের একজন শিক্ষক বা মুরুব্বী।
তখন মধ্যে মধ্যে আর্টস্ ফ্যাকাল্টির ৩২৫ নং রুমে বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হতো। ড. করিম স্যার ও খাঁন স্যারের তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ বক্তব্য শোনার জন্য অন্যান্য বক্তা বা গবেষণারত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে থাকতেন। ড. করিম স্যারের বক্তব্য সব সময় সাধারণ্যে বোধগম্য, বিষয় ভিত্তিতে সংক্ষেপ এবং স্পষ্ট যাকে মেথডিকেল বলা হয়। কিন্তু ড. খাঁন স্যার আলোচনাকালে স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে বিষয়ের অতীব গভীরে চলে যেতেন যা ধারণ করা গবেষকরা ছাড়া সাধারণ শ্রোতার জন্য কঠিনই ছিল।
পরবর্তীতেও কিছু অনুষ্ঠানে স্যারের বক্তৃতা আমি শুনেছি। স্যার যখন বক্তৃতা করতেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্যারের প্রজ্ঞাসম্পন্ন ধারালো মেধা দিয়ে গবেষণালব্ধ পুরো বিষয়টি নিখুঁত ও বিস্তারিতভাবে পাঠক সমীপে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট ও সযত্ন থাকতেন। এখানে আমি শুধু একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৮৫ সালে তখনকার প্রসিদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হীরামন এসোসিয়েট্স্ এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মরহুম হারুনুর রশীদ চৌধুরী কন্ট্রাক্টরের স্মৃতিতে প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় মইনুদ্দীন স্যার ছিলেন প্রধান অতিথি। তিনি হারুন সাহেবের জীবিত অবস্থার কিছু ভূমিকা বা কাজের কথা তুলে ধরেন। এবং বলেন যে হারুন সাহেবের কাজগুলো জনগণ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর। কল্যাণকামী মানুষেরাই কল্যাণকর কাজ করে থাকেন। মানুষের এই কল্যানকামীতা মহান স্রষ্টা প্রদত্ত এক বিশেষ গুন। স্রষ্টা নিজেই একচ্ছত্র কল্যানকামী। তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষ ও মানুষ্য সমাজে এই কল্যাণকর কাজটি বিরাজিত থাকার জন্য স্রষ্টা দয়া করে সৃষ্টি জগতের কিছু মানুষকে বিশেষ প্রয়োজনীয় মাত্রায় কল্যাণকামীতার গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেন।
স্যারের এই বক্তৃতাটা ছিল প্রায় ৪২ মিনিটের। দর্শক সারিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনছিলাম আমরা কয়জন মাত্র। বক্তৃতা শেষে পিছন ফিরে দেখি হলভর্তি শ্রোতা সব বাইরে গিয়ে যার যার মতো গল্পে মশগুল। স্যারের এই বক্তৃতা থেকে আমার ভেতরে জমা থাকা কিছু স্মৃতিকথা অদ্যাবধি সময় ও ক্ষেত্র বিশেষে আমাকে চিন্তায় ও বলনে সাহায্য করে।
বিষয়টি নিয়ে ড. করিম স্যারের সাথে আলাপ করেছিলাম। মইনুদ্দীন স্যার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য একটি ঘটনা সহকারে উপস্থাপন করছি –সম্ভবত ২০১০ সালে প্রজন্ম বাঁশখালী নামক একটি সংগঠন মোমিন রোডের মৌ. মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী হলে ড. আবদুল করিম স্যার স্মরণে একটি সভার আয়োজন করে। প্রধান আলোচক ড. মইনুদ্দীন স্যারের পাশে সৌভাগ্যবশত: আমিও ছিলাম। আমার বক্তৃতার একটি অংশ ছিল এরূপ –
“দীর্ঘদিন ড. আবদুল করিম স্যারের সাহচর্যে চলতে গিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম এমনকি দেশ বিদেশের অনেক পণ্ডিত–গবেষকদের নিয়ে স্যারের স্মৃতিচারণ ও মন্তব্য শুনার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাষায় ‘ড. মইনুদ্দীনের গবেষণা পিপাসা এতো প্রবল ছিল যে, তিনি বিষয়ের অনেক গভীরে চলে যান। মনে হয়, যেন গবেষনার এই স্তর থেকে একটি সিদ্ধান্ত বের করে আনা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। সুতরাং মইনুদ্দীন এবার লস্ট। কিন্তু বলতে বলতে দেখা যায় ঠিকই মইনুদ্দীন গবেষণার মূল্যবান একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন,উপস্থাপন করেছেন। এ–ই হচ্ছে মইনুদ্দীনের গবেষনার বৈশিষ্ট’।
অপরদিকে ড. আবদুল করিম স্যারের মৃত্যুর পর ১ সেপ্টেম্বও ২০০৭ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রথম স্মরণ সভায় আজকের মঞ্চে উপবিষ্ট পরম শ্রদ্ধেয় ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান স্যার তাঁর দীর্ঘ জীবনের সাথীর জীবন নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন – ‘গবেষণার ক্ষেত্রে প্রত্যেক গবেষকের এক একটি ম্যাথডোলজি থাকে। আমারও একটি আছে। কিন্তু ড. আবদুল করিমের যে ম্যাথডোলজি ছিল তা অন্য অনেক ম্যাথডোলজির চাইতে উন্নত মানের। এর মাধ্যমে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোয়াসে’ তিনি একটি উদাহরণও সৃষ্টি করেন। এ জন্য তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে অন্য অনেকের চাইতে তুলনামূলক বেশি সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।”
ড. আবদুল করিম স্যার ও মইনুদ্দীন খান স্যার উভয়ে একে অপরের বিষয়ে তাঁদের মূল্যায়ন তুলে ধরায় স্যার আমাকে বললেন, “আমার বয়স সামান্য বেশি হলেও করিম আর আমি ছিলাম সমসাময়িক। একে অপরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতাম। দু‘জনে খুনসুটি করতাম। তোমার বক্তব্যে আমাদের নিত্য আলোচনার বিষয়বস্তু বর্ণিত হযেছে। প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম সাহেবের সাথেও আমাদের একই সম্পর্ক ছিল। তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা হলেও তিনি কলেজ সাংগঠনিক কাজ বাদ দিয়ে যান নাই”।
একদিন স্যারের বাসায় গেলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে একজনকে বললেন, “আমাদের জন্য প্লাস্টিকের মোড়কবন্দি কেক নিয়ে আস দোকান থেকে”। উল্লেখ্য, স্যারের বাসার নীচ তলায় বৈঠকখানা কাম ক্লাশরুমের পাশে একটি রুমে একজন লোক স্টেশনারী দ্রব্যাদির দোকান করতো। স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দোকানের সাথে আমার চুক্তি আছে, সে খাদ্য সরবরাহ করে আমাকে দর্শনার্থী আপ্যায়নের সুযোগ দিবে। পরে ভাড়ার টাকার বিপরীতে এগুলোর হিসেব হবে’। আমি একটু হেসে বললাম, স্যারের বাড়ি আমাদের কথিত (ব্যবসায়ীক প্রধান) সাতকানিয়া বটে। স্যারও মজা করে বললেন, ‘জীবের প্রথম চাহিদা খাবার। আয় ব্যয়ের সঠিক ব্যবস্থা করতে না জানলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তাই এই জ্ঞান সার্বজনীন প্রযোজ্য’।
কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর তিনি আমাকে তাঁর লিখা কয়েকটি প্রবন্ধ দিয়ে বললেন, পড়িও। আমি পড়েছি, কিন্তু সম্প্রতি বই ও কাগজের ভিড়ে প্রবন্ধগুলো কোথায় যেন লুকিয়ে আছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে প্রবন্ধগুলো ধর্মভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তিনি বলতে ছেয়েছেন, ‘যে কোন ধর্মের বাণী সর্বজনীন শিক্ষা নিয়ে এসেছে। কিন্তু ধর্মানুসারীরা কালে তা শ্রেনিতে বা শ্রেণিভিত্তিক কুক্ষিগত করে রেখেছে। যেন নিজ ধর্মের লোক ছাড়া আর কারো পক্ষে আমার ধর্ম নিয়ে চিন্তা বা চর্চা করা যাবে না। মানুষের এই ধারণা ঠিক নয়’। ঐ লিখাগুলোর কিছু কিছু অংশ নিয়ে স্যারের সাথে বসে আরো বিস্তারিত বুঝে নেয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও তা আমার সময়াভাবে সম্ভব হয়ে উঠে নাই।
ড. আবদুল করিম স্যার জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁরই পরামর্শ বা সম্মতিতে এম.ই.এস সোসাইটি ভবনে সন্ধীপের সাবেক এম.পি রফিকুল্লাহ চৌধুরীর পুরুহিত্যে চট্টগ্রামের ইতহাস চর্চা বা এরূপ কিছু একটা সংগঠন করার প্রস্তুতি চলছিল। বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আর আই চৌধুরী স্যার সহ ইতিহাসপ্রেমি গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। আর আই চৌধুরী স্যারকে সভাপতি ও মইনুদ্দীন খান স্যারকে সহ–সভাপতি করে একটি কমিটি গঠিত হয়। ড. আবদুল করিম স্যারের সরাসরি নির্দেশে আমাকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়। যদিও তাতে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করেছিলাম। ড. করিম স্যারের মৃত্যুর পর ৪/৫টি মিটিং করা ছাড়া প্রস্তাবিত কমিটির কার্যক্রম আর আগায় নাই। অত:পর মুমিন রোডের ‘মোগল বিরিয়ানী হাউস’ নামক হোটেলে কবি সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের সভাপতিত্বে পুনরায় আর একটি বৈঠক করে আমারই প্রস্তাবে ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান স্যারকে সভাপতি ও সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়াত ইতিহাস গবেষক বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জনাব আহমদ মমতাজকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষণা পরিষদ’ নামক একটি কমিটি করা হয়। এই প্রস্তাব নিয়ে আমরা কয়েকজন খান স্যারের বাসায গেলে স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পদ কি ? আমি বললাম, “স্যার আমার প্রাথমিক কাজ হবে আপনাকে মিটিং–এ আনা নেয়া করা, অতঃপর আপনি যে নির্দেশ দিবেন তা পালন করা। স্যার বললেন, পদ দিয়ে মানুষকে ধরে রাখা যায় না, আর তুমি এমনিতেই কাজ করবা? আমি বললাম, ‘ড. করিম স্যার বেঁচে থাকলে আমার বিষয়ে তিনিই এই জবাবটি দিতেন’। স্যার বললেন, ‘সংগঠন করা বড়ই কঠিন কাজ। আমি সংগঠন করার মানুষ নই। তোমরা সবাই কাজ করলে আমি তোমাদের কাছে উদ্ভুত প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করবো’। অর্থাৎ আমি তোমাদের একজন বয়স্ক ছাত্র, এরপর কিছু ফটোসেশন হয়েছিল। এবারও প্রস্তাবিত সংগঠনটি ওখান থেকেই চিরনিদ্্রায় চলে গেল।
এরপর স্যারের সাথে বড়জোর ৩/৪ বার দেখা হয়েছিল। বিনয়ের সঙ্গে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করলে স্যার স্বভাবসিদ্ধ, যুক্তিনির্ভর দৃঢ় জবাব দিতেন, “বয়স হয়েছে, একদিকে অসুখে টানছে, অন্যদিকে ঔষধে টানছে। এখনো অসুখের চাইতে ঔষধের টান প্রবল। সুতরাং চলা ফেরা করতে পারছি।”
পরিশেষে আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও প্রফেসর এমিেেরটাস, জাতীয় অধ্যাপক, একুশে পদক প্রাপ্ত ইতিহাসবিদ ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন এর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি যুক্ত করি – “ড. মইনুদ্দীন আহমদ খাঁন আমার অগ্রজপ্রতিম। তিনি সহজ সরল সৎ এবং কল্যাণ চিন্তার অসাধারণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর গবেষণা কর্ম অনেক মূল্যবান। বিশেষ করে তাঁর অভিসন্দর্ভ – ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ এর মাধ্যমে বৃটিশ ভারতের রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উম্মোচিত হয়েছে। যেগুলো ইতিহাসের অনবদ্য খোরাক।”
আজ অধ্যাপক মইনুদ্দীন আহমদ খান স্যার আমাদের মধ্যে জীবিত নাই। দীর্ঘ ৯৭ বৎসরাধিক কালের বরকতময় সক্ষম হায়াত শেষে তিনি ইহজগত ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমরা সাধারণ মানুষ। তাঁর দীক্ষা গ্রহণকারী সচেতন গবেষকরাই সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন স্যারের প্রকৃত অভাবের মাত্রা। আমরা কায়মনোবাক্যে স্যারের শান্তিপূর্ণ বেহেশতবাস কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা–সংগঠক।