প্রজন্মকে বাঁচাতে ডিজিটাল আসক্তি রুখতে হবে

| রবিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ডিজিটাল আসক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে শিশুকিশোর ও তরুণ প্রজন্ম। এই আসক্তি মাদকের চেয়ে কম নয় বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে- ফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া। সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বেশি। ডিজিটাল আসক্তি যেন এখন ডিজিটাল আগ্রাসনের নাম, যাকে রুখতে না পারলে আমাদের আগামী প্রজন্ম আলোর দিশা হারিয়ে ফেলবে।
এদিকে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কম বয়সী ছাত্রছাত্রীরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। দিন নেই, রাত নেই, সব সময় মোবাইলে পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেম খেলছে। এমনকি খেতে না চাইলে কখনও কখনও মা-বাবা বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। এভাবে কোমলমতি শিশুরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল ফোনে। ছোট শিশু এবং প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের অ্যাপ, গেম, ভিডিও, চ্যাটিং নেশায় পরিণত হয়েছে।
মনোচিকিৎসকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে মোবাইলে গেম খেলছে। এটা এক সময় নেশায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে গেম খেলা মদ, গাঁজা, হেরোইনের নেশার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নেশায় পড়লে সেখান থেকে সরে আসা কঠিন। অনেকেই প্রেমঘটিত টানাপোড়েন, আর্থিক সঙ্কট, বিষণ্নতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মোবাইল গেমে আসক্ত হচ্ছেন। অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছেন না।
বাংলাদেশ টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) অনুসারে, ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রায় ৯.৩৭ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। ২০১৬ সালের তথ্য অনুসারে, শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের, অর্থাৎ কিশোর-কিশোরী। মহামারীর সময় এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এগুলি বেশিরভাগই অস্বাভাবিকভাবে ডিজিটাল আসক্তির ঝুঁকিতে থাকে। ২০১৮ সালে আইসিডি -১১ এর একাদশ সংশোধিত সংস্করণে, গেমিং আসক্তি একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল, যা এটি ২০২২ সালে প্রকাশিত আইসিডি -১১ শীর্ষক ডায়াগনসিস গাইড বইয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। অন্য কথায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেমস, সেল ফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমসের ক্ষতিকারক ব্যবহারকে একটি রোগ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, যাকে ডিজিটাল আসক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন। মজার বিষয় হ’ল, যারা এই গেমগুলি তৈরি করছে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের এই গেমাসক্তি থেকে দূরে রেখেছেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হ’ল পরবর্তী প্রজন্মকে বুদ্ধিহীন অনুগত অনুসারী হিসেবে তৈরি করা।
একাধিক সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের ৮৭ কোটি ছেলেমেয়ে প্রতিদিন পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার খেলছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি ডাউনলোড করা হচ্ছে। অন্য একটি অনলাইন সমীক্ষা বলছে যে বাংলাদেশে প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি এ গেম খেলা হচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ফ্রি ফায়ার গেমটি খেলছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ খেলছে। অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে যে কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ৮.৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্ত। এর মধ্যে ৪.৮ শতাংশ কিশোর এবং ১.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক।
দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার এবং এর তাৎক্ষণিক উপকারিতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু লেখাপড়ার এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে। যদিও শিক্ষার্থী, বিশেষ করে অনেক ছোট শিশুই করোনার আগে থেকেই মোবাইল স্ক্রিনে ডিজিটাল গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডিভাইস-প্রীতি মাদকের চেয়েও ভয়াবহ। একজন মাদকসেবী মাদক না পেলে, নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়; একইভাবে অনলাইন গেম আসক্তরা গেমটি খেলতে না পেরে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা করে না। মাদকের আসক্তির মতো, অনলাইন গেম থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। তবে দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা পরিষেবাদিতে নিজেকে জড়িত রেখে গেমের আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাঁরা অভিভাবকের সচেতনতাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে