ভূমিকা :
সাগর, পাহাড়, নদী আর সমতলের অনন্য মিলনে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই শহরের রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য, বাণিজ্যের ঐতিহ্য ও মানুষের প্রাণশক্তি। কিন্তু আজ এই বন্দরনগর ক্লান্ত্তজলাবদ্ধতা, যানজট, বর্জ্য, দূষণ আর সেবাহীনতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে নাগরিক স্বস্তি। অথচ চট্টগ্রামের মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখে একটি সহজ, তৃপ্ত, সাংস্কৃতিক আবহ ও মানবিক শহরের, যেখানে নাগরিক সেবা হবে মানসম্মত, দ্রুত, সমন্বিত ও জবাবদিহিমূলক। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একমাত্র পথপ্রকৃত স্বায়ত্তশাসিত সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা।
চট্টগ্রামের সম্ভাবনা:
চট্টগ্রাম দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। দেশের মোট আমদানি–রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় এখান দিয়ে। কর্ণফুলী ও হালদা নদী, বন্দর, ইপিজেড, বে–টার্মিনাল (নির্মাণাধীন), অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন এবং শিল্পাঞ্চল সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতির লাইফলাইন।
এমন একটি শহর পরিকল্পিত ও সমন্বিত ভাবে গড়ে উঠলে হতে পারত দক্ষিণ এশিয়ার লজিস্টিকস ও মেরিটাইম হাব, পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের গেটওয়ে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা সমন্বিত হতে প্রয়োজন এক কেন্দ্রিক পরিচালন ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার উল্টো: অপর্যাপ্ত ও অবিন্যস্ত রাস্তাঘাট, ত্রুটিপূর্ণ জলনিকাশ ব্যবস্থা, অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সম্ভাবনা হারাচ্ছে এই নগর।
সমস্যার মূল কারণ:
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন আয়তন প্রায় ১৫৫ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০–৭০ লাখ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবা ভাগ হয়ে আছে অন্তত ২০টিরও বেশি সংস্থার মধ্যে।
পানি সরবরাহে চট্টগ্রাম ওয়াসা, গ্যাসে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, বিদ্যুতে পিডিবি, প্লানিং কন্ট্রোলে সিডিএ, বন্দর এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ, আইনশৃংখলায় পুলিশ,স্বাস্থ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষায় শিক্ষা বিভাগ ইত্যাদি আর বর্জ্য, স্বাস্থ্য (আংশিক), শিক্ষা (বহুলাংশ), ড্রেনেজ ও সড়ক আলোকায়ন সহ অন্যান্য নাগরিক সেবায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
ফলে এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে পাইপ বসায়, অন্য সংস্থা পরে তা কাটে তার বসাতে। এই বিশৃঙ্খল সমন্বয়হীনতা তৈরি করছে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি, যানজট, জলাবদ্ধতা ও অর্থের অপচয়, সর্বোপরি সীমাহীন জন দুর্ভোগ।
বন্দরের কনটেইনার ট্রাক চলাচল, ওভারলোডেড যানবাহনের কারণে সড়কের ক্ষয়, শিল্পাঞ্চলের দূষণ ও খাল দখল সব মিলিয়ে নগরজীবন প্রতিদিনই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
এই সমস্যার আরেকটি বড় দিক হলো সিটি কর্পোরেশনের সীমিত ক্ষমতা। বাজেট অনুমোদন, প্রকল্প বাস্তবায়ন বা কর নির্ধারণ সব ক্ষেত্রেই মন্ত্রণালয়ের অনুমতি বাধ্যতামূলক। ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র বাস্তবে নির্বাহী ক্ষমতাহীন।
আইন ও সংবিধান যা বলে:
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ এ স্থানীয় সরকারকে নির্বাচিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৫৯(১): “স্থানীয় সরকার স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হইবে।”
অনুচ্ছেদ ৬০: “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে আইন দ্বারা প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা এবং দায়িত্ব অর্পণ করা হইবে।”
অর্থাৎ সংবিধান নিজেই বলছে, স্থানীয় সরকারকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সিটি কর্পোরেশন আইন ২০০৯ এ অসংখ্য ধারা ও উপধারায় “ধং সধু নব ঢ়ৎবংপৎরনবফ” শব্দবন্ধ যুক্ত করে মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ধারা ১০০(২) বলছে
“কর্পোরেশন কোনো কর, রেট, টোল, ফি বা চার্জ আরোপ করিতে পারিবে, ধং সধু নব ঢ়ৎবংপৎরনবফ।”
অর্থাৎ কর আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাস্তবে তা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের বিধি বা অনুমতির প্রয়োজন হয়। এভাবে আইনেই সিটি কর্পোরেশনের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা হয়েছে।
সিটি গভর্নমেন্ট মডেল একীভূত সমাধান: বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ হলো সিটি গভর্নমেন্ট যেখানে মেয়রের নেতৃত্বে সব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এক প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে কাজ করবে।
লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টোকিও, সিউল, সাংহাই অনেক বড় শহরেই এই মডেল সফলভাবে চলছে।
চট্টগ্রামে এটি চালু হলে বন্দর, সড়ক, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বর্জ্য, পরিবেশ, ট্রাফিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নগর পরিকল্পনা সহ সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত পরিকল্পনা সম্ভব হবে। এতে সময় ও অর্থের অপচয় কমবে, জবাবদিহিতা বাড়বে এবং নাগরিক সেবা হবে দ্রুত, মানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য।
সিটি গভর্নমেন্টে চট্টগ্রামের সুবিধা: ১. এক জানালায় সেবা: নাগরিককে আর ২০টি বা ততোধিক অফিস ঘুরতে হবে না এক জায়গায় অভিযোগ, এক জায়গায় সমাধান। ২. সমন্বিত উন্নয়ন: এক প্রকল্পের কাজ অন্য সংস্থার কাজে বিঘ্ন ঘটাবে না বা বিলম্বিত করবে না। ৩. জবাবদিহিতা: মেয়র সরাসরি নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ হবেন। ৪. অর্থনৈতিক গতি: বন্দরের সঙ্গে যুক্ত শিল্পাঞ্চল ও অবকাঠামো একত্রে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হবে। ৫. পরিবেশ সুরক্ষা: খাল পুনরুদ্ধার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পাহাড় রক্ষা সবকিছু হবে একক নীতির আওতায়। ৬. স্মার্ট নাগরিক জীবন: ডিজিটাল সেবা, অনলাইন বিল, স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম নাগরিকের নাগালে আসবে। ৭. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ইত্যাদিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হবে। ৮. অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করে পরিকল্পিত নগরায়ন সম্ভব হবে।
সম্ভাব্য আয়ের উৎস: চট্টগ্রাম সিটি গভর্নমেন্ট স্বশাসিত হলে সরকারি বরাদ্দের বাইরে নিজস্ব রাজস্ব আহরণের সুযোগ বাড়বে। সম্ভাব্য উৎসগুলো হলো–
হোল্ডিং ট্যাক্স ও সম্পত্তি করের আধুনিকায়ন: জিআইএস ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে সঠিক কর আদায়।
সিটি হোটেল ট্যাক্স: পর্যটননগরী হিসেবে হোটেল–মোটেল থেকে প্রতি রাত্রিযাপনে নির্দিষ্ট সিটি ট্যাক্স আদায়।
বন্দর ও শিল্পাঞ্চল সার্ভিস ফি: বন্দরের ব্যবহৃত সড়ক ও সেবার বিনিময়ে কর্পোরেশনের আয়।
পার্কিং, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ (চচচ)।
নগর বন্ড ইস্যু: অবকাঠামো উন্নয়নে নাগরিক বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি।
বিদেশি ঋণ বা সহায়তা গ্রহণের স্বাধীনতা: আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরাসরি উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহ।
এই উৎসগুলো কাজে লাগানো সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পুরোপুরি সিটি গভর্নমেন্টের হাতে থাকবে।
উপসংহার : চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন, কিন্তু একই সঙ্গে এটি এখন সেবাহীনতার প্রতীক। অসংখ্য সংস্থা, বহুমুখী কর্তৃত্ব জনিত সমন্বয়হীন প্রশাসন ও মন্ত্রণালয় নির্ভর কাঠামো নগরজীবনকে অকার্যকর করে তুলেছে।
সংবিধান স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেও, বাস্তবে সেই ক্ষমতা আজও কাগজে বন্দী এবং নানা কৌশলে তা আরও খর্ব করা হচ্ছে। সুতরাং সময় এসেছে কার্যকর পরিবর্তনের এর শুরু হতে পারে চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রামে প্রকৃত সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। এটি বাস্তবায়িত হলে এই শহর শুধু নিজের নয়, দেশেরও মুখ উজ্জ্বল করবে। চট্টগ্রাম তখন হয়ে উঠবে মানবিক, আধুনিক ও টেকসই বন্দরনগরী যার অনুকরণে ঢাকা সহ অন্যান্য জনবহুল নগরগুলোও নিজেদের সিটি গভর্নমেন্ট গড়ে তুলবে। আজকের এই সময়ে এক কথায় বলা যায়– স্বশাসিত সিটি গভর্নমেন্ট এখন বিলাসিতা নয়, এটি চট্টগ্রামের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি। যা ভবিষ্যতে পুরো দেশকে আলো দেখাবে।
লেখক: প্রকৌশলী, নগর উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক।










