নগরবাসী জানেন, ঈদের দিন সকাল পৌনে দশটার পর নগরীতে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি নামে। সাথে ঝড়ো হাওয়া। কড়া লকডাউনেও নগরীর প্রধান মসজিদ জমিয়তুল ফালাহসহ অনেক মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জমিয়তুল ফালাহ ও বেশ কয়েক স্থানে ক’দফায় ঈদ জামাত হয়। শেষ জামাতের অনেক মুছল্লি বৃষ্টিতে আটকেও যান। বৃষ্টির স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ এক ঘন্টার বেশি। এর মাঝে নগরীর নিম্নাঞ্চল বিশেষ করে চকবাজার, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, মুরাদপুর, চান্দগাঁও আবাসিক, নাসিরাবাদ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক, কাতালগঞ্জ, ২ নম্বর গেট, জিইসি, ওয়াসা মোড়, চাক্তাইসহ নগরীর বিশাল অংশ পানিতে ডুবে যায়। একঘন্টার বৃষ্টির জলজটের স্থায়িত্ব হয় ন্যূনতম তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা! কেন এমন হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো তার পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও দিয়েছে। চকবাজার, মোহাম্মদপুর, বাকলিয়া, বাদুরতলা এলাকার বহু মানুষ ঈদ জামাত শেষে বাসায় ফিরেছেন হাঁটু বা কোমর পানি ভেঙে। এসব এলাকার নিচতলার বহু বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরোই পানিতে ডুবে যায়। নগরে জলবন্দি মানুষের যন্ত্রণা নতুন কিছু নয়। কিন্তু পুরো রমজান মাসজুড়ে তীব্র গরমের মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি ও বন্যা ঈদের আনন্দ পুরোপুরি ভাসিয়ে নেয়।
রোগটা চট্টগ্রামের বহু পুরানো। টোটকা চিকিৎসা হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু রোগমুক্তির বদলে উল্টো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বাঙ্গে। সর্বশেষ ক’বছর আগে জলাবদ্ধতা নিরাময়ে সিডিএ,ওয়াসাকে ৬ হাজার কোটি টাকার মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সিডিএ রোগ নির্ণয় করে নগরীর প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদীসহ অসংখ্য খাল, নালা অবৈধ দখলমুক্তির পাশাপাশি জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে কাজ করছে। ওয়াসা বাস্তবায়ন করছে স্যুয়ারেজ বা পয়ঃনিস্কাশন প্রকল্প। সুফল কখন আসবে, উত্তর দেবে সময়। বিষয়টা এখানেই থাক। আসি শিরোনাম প্রসঙ্গে। ঈদ উপহার বৃষ্টির আগে অনেকদিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ চলছিল। বৃষ্টির সাথে ঘন্টার দমকা বাতাস অসহ্য গরমের ক্ষণিক বিরতি টানে। আকস্মিক শীতলতায় চনমনে হয় অস্থির মানুষ। কিন্তু অদ্ভুত বিস্ময়, ঝড়-বৃষ্টির পর সূর্য আবারও পূর্ণশক্তি নিয়ে তাপ ঢালতে থাকে। জলজটে ডুবো নগরে দ্রুতই তীব্র গরমে মানুষের হাঁসফাঁস শুরু হয়। গরমের শক্তি দিনে দিনে আরও বাড়ছে। ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে মোটামুটি। কিন্তু বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাসেও চট্টগ্রামে ঈদ উপহারের পর বৃষ্টির দেখা নেই। প্রকৃতি ঈদের আকস্মিক উপহারটি ঢেলেছে শুধু নগরে গ্রাম বা বৃহত্তর চট্টগ্রামে নয়। উজানে বা গ্রামে ওই এক ঘন্টার টানা বৃষ্টি হলে হালদা অববাহিকায় অন্তত নতুন পানি নামত। হালদায় বহুল প্রত্যাশার কার্প বা রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ত প্রথম রাউন্ড। এটা প্রকৃতির নতুন খেয়াল। আবহাওয়ািদ বা পরিবেশ-প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞরাও প্রকৃতির নতুন খেয়াল নিয়ে কিছু বলেননি। ওদিকে হালদায় ডিম সংগ্রাহক নৌকাগুলো প্রথম রাউন্ড ডিম না পেলেও পরবর্তী ‘জো’ এর অপেক্ষায় চক্কর খাচ্ছে টানা।
প্রকৃতির বিরূপ আচরণের দায় পুরোই আমাদের ঘাড়ে নিতে হয়। প্রকৃতির উপর টানা অত্যাচার, অবাধ বৃক্ষ নিধন, খালবিল, হাওর, পাহাড় দখল করে নতুন আবাসন ও স্থাপনা তৈরির তীব্র প্রতিযোগিতা চলছেই। অবাধ কার্বন, সীসা নিঃস্বরণ থামানোরও কোন উদ্যোগ বৈশ্বিক পর্যায়ে যেমন নেই, দেশীয় পর্যায়ে তো একদমই না। উল্টো পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠীর আবাসন, জীবিকা, সংস্কৃতি উপড়ে ফেলে সেখানে পাঁচতারা হোটেল রিসোর্ট তৈরি করার মত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছি আমরা। অথচ চট্টগ্রাম নগরীকে থাইল্যান্ডের পুকেট এবং কঙবাজারকে পাতাইয়া বিচের চেয়েও উন্নত পর্যটন নিসর্গ হিসাবে গড়ার প্রচুর সুযোগ আমাদের আছে। দুঃখ, আমাদের দেশি কর্পোরেটগুলোও মেধা-সৃজন, উদ্যম, নবতর আইডিয়ার বদলে পুরোই সামন্ত যুগের জমিদারিতে পশ্চাদপসরণ করছে। কোভিড-১৯ এর মত অচেনা কীটাণুর বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি যেমন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর নেই। তেমনি আমাদেরও নেই জনসংখ্যার চাপে ন্যূব্জ দেশটির অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ধংসের বদলে সদ্ব্যবহারের সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোগ ও আইডিয়া। করোনা যেমন বিশ্ববাসীকে মুখোশ বা মাস্ক সভ্যতায় টেনে নিচ্ছে, তেমনি আমরাও উন্নয়নের নামে যথেচ্ছ ভোগ-বিলাসকে জায়েজ করতে চিন্তাা-মেধা-মনন বর্গা দিয়ে ফিরে যাচ্ছি মধ্যযুগের আঁধার সভ্যতায়। এ অবস্থায় প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নানা মাত্রার নতুন ও কঠিন আঘাত হেনে নিতেই থাকবে।