প্রতিটি মানুষ প্রকৃতিসহ একে অপরের সাথে আন্তঃ সম্পর্কিত, আত্মনির্ভরশীল। এমনকি আত্মাসহ মহান রাব্বুল আলামিনের সাথেও কানেক্টটেড। কিছু দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্য।
মহাকাশে গ্রহ–নক্ষত্র, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনের ফলে প্রকৃতিতে যে ঘটনা ঘটে, তা জানা যায় অ্যাস্ট্রনমির মাধ্যমে। এ মহৎ কর্মে সম্পৃক্তদের জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলে। অপরদিকে আকাশে ঘূর্ণনের ফলে প্রকৃতিসহ মানবকুলে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা জানা যায় অ্যাস্ট্রলজির মাধ্যমে। আর এই প্রভাব যারা অনুভব করতে পারেন তাঁদের বলে জ্যোতিষবিজ্ঞানী। এটি বোঝার জন্য প্রয়োজন অনুভূতি। এটি আসে চেতনা থেকে। চেতনা হলো অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আধ্যাত্মিক শক্তি। যেটি সর্বদা সময় ও কালের ঊর্ধ্বে বিচরণ করে। চেতনা এমনিতে আসে না। কঠোর সাধনায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে অর্জন হয়। এঁরা মুনি–ঋষি–আউলিয়া নামে পরিচিত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের মুনি–ঋষিরা প্রকৃতির রহস্য সন্ধান করতে গিয়ে প্রকৃতির মালিকের দর্শনপ্রাপ্ত হয়ে মহাজ্ঞানী হন। মুনি–ঋষি– আউলিয়াগণ অতীন্দ্রিয় জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে দিব্যদৃষ্টি দ্বারা গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাব উপলব্ধি করেন।
অ্যাস্ট্রলজি ও অ্যাস্ট্রনমি একসূত্রে গাঁথা। বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রনমি সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। অপরদিকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রলজি, অ্যাস্ট্রনমিসহ পরিপূর্ণ প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। অ্যাস্ট্রলজি চর্চা করতে গেলে অ্যাস্ট্রনমি সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। কারণ একটি অপরটির পরিপূরক। অ্যাস্ট্রলজি অতীন্দ্রিয় জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয় বলে সাধারণ মানুষ এই শাস্ত্র সহজে বুঝতে পারে না। কারণ অধিকাংশ মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে ধারণা খুব কম। অ্যাস্ট্রনমি হল ভৌত জ্ঞান। অপরদিকে অ্যাস্ট্রলজি হলো অনুভূতিলব্ধ ইন্দ্রিয়বাহ্য জ্ঞান। প্রতিটি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ নিহিত। যদি এই জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানুষের নিকট উপস্থাপন করা যায় তাহলে সকলেই গ্রহণ করবে। কিন্তু বর্তমানে যারা অ্যাস্ট্রলজি চর্চা করে তাদের অধিকাংশই অ্যাস্ট্রনমি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না। ফলে এই বিষয়কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানুষের নিকট উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। তাই আধুনিক যুগে প্রকৃত জ্যোতিষীদের উচিৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। পাশাপাশি মহাকাশ সম্পর্কে ধারণা রাখা। এতে জ্যোতিষীদের অন্তরে চেতনার জাগরণ ঘটবে এবং বৈজ্ঞানিক মন মানসিকতা সৃষ্টি হবে। সার্বিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। অ্যাস্ট্রলজি ও অ্যাস্ট্রনমি একটি অপরটির পরিপূরক বলে তৎকালীন বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকায় ‘ইলমে আল নজ্জুমি’ (যাকে একসাথে অ্যাস্ট্রনমি ও অ্যাস্ট্রলজি বলে) অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেটি তৎকালীন বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম এবং এর অধ্যক্ষ ছিলেন অলিকুলের শিরোমণি পীরানপীর দস্তগীর হজরত শেখ সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের (ক.) জিলানী।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআন শরীফে প্রায় ৩৬ টি সূরার বিভিন্ন আয়াতে জ্যোতিষ বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এও বলেছেন যে এই আয়াত সমূহ জ্ঞানীদের জন্য বর্ণিত। অ্যাস্ট্রলজির সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, এর সাথে ধর্মেরও কোনো বিরোধ নেই। বরং অ্যাস্ট্রলজি, অ্যাস্ট্রনমি ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। অনেকে ধর্ম বিশ্বাস করে, কিন্তু বিজ্ঞান মানতে নারাজ। আবার কিছুলোক বিজ্ঞান মানে কিন্তু আধ্যাত্মিকতাকে স্বীকার করে না। এই ধরনের লোকেরাই জ্যোতিষ বিজ্ঞান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে। যারা বিজ্ঞান মনস্ক তারা যদি আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা রাখে এবং যারা ধর্ম বিশ্বাস করে, সাথে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা ধারণ করে; তাহলে দ্বন্দ্বের অবসান হবে। পশ্চিমাদেশের অধিকাংশই আধ্যাত্মবাদ তেমন একটা গ্রহণ করে না। তারা প্রত্যেকটিতে প্রমাণ খুঁজে। ভারতবর্ষের সাথে পশ্চিমারাষ্ট্র সমূহের তফাৎ হলো– ভারতবর্ষের প্রধান সম্পদ মুনি–ঋষি–আউলিয়াদের মাধ্যমে পাওয়া আধ্যাত্মিক জ্ঞান। অপরদিকে পশ্চিমাদের আছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে আধ্যাত্মিকতা বুঝে না। যেখানে আধ্যাত্মিকতা সেখানেই বিজ্ঞান। যেদিন ভারতবর্ষের মানুষ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে নিহিত বৈজ্ঞানিক ঘটনা গবেষণা করে বিজ্ঞানের সমন্বয় করতে পারবে সেদিন পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ থেকে শত বছর এগিয়ে থাকবে। আধ্যাত্মিক জ্ঞান আর বিজ্ঞানের সমন্বয় হলে পশ্চিমারাও তা গ্রহণ এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নিবে।
মুনি ঋষিদের প্রাপ্তজ্ঞানশাস্ত্র নামে পরিচিত অ্যাস্ট্রলজির মাধ্যমে প্রকৃতিসহ মানবের উপর গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এখানে চন্দ্র ও সূর্যের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তুলে ধরলাম।
রবি হলো একটি নক্ষত্র, চন্দ্র হলো পৃথিবীর উপগ্রহ। এর প্রভাব এত বেশি যে গ্রহ না হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন ঋষিগণ গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বরং রবিকে গ্রহরাজ বলা হয়েছে। পৃথিবীতে মানবকুলসহ প্রকৃতির উপর চন্দ্র ও সূর্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কোরআন শরীফে আল্লাহ পাক বিভিন্ন সূরার একাধিক আয়াতে চন্দ্র ও সূর্যের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘এই আয়াতসমূহ জ্ঞানী সমপ্রদায়ের জন্য’। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি উষার উন্মেষ ঘটান বিশ্রামের জন্য রাত এবং সূর্য–চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন গণনার জন্য। আবার তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন, যাতে জলে–স্থলে অন্ধকারে পথ পাও। জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে এসব আয়াতে নির্দেশনা’ (সূরা আনআম, আয়াত ৯৬ ও ৯৭)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সূর্যকে তেজস্বী ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন। তিনি নির্দিষ্ট করেছেন যাতে বছর গণনা ও কাল নির্ণয় হিসাব জানতে পারো। এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। জ্ঞানী সমপ্রদায়ের জন্য এসব আয়াত বর্ণিত হয়েছে’ (সূরা ইউনুস আয়াত ৫)। তিনি আরো বলেছেন, ‘কত মহান তিনি, যিনি নভোমণ্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং স্থাপন করেছেন সূর্য ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র’ (সূরা ফুরকান, আয়াত ৬১)। রবিকে প্রাণ বা আত্মা বলা হয়েছে। আবার সূর্য জীবনীশক্তিরও কারক। কারণ সূর্যের আলোর মাধ্যমে পৃথিবীতে জীবের উৎপত্তি হয়েছে। মহাকাশ থেকে সূর্যের আলোর মাধ্যমে পলিমার (ড়ৎমধহরপ সড়ষরপঁষব) পৃথিবীতে আসে। মৈত্রীয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে আছে, ‘রোহিণী নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে জীবের উৎপত্তি’। বিজ্ঞান বলে –সূর্যের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে নাইট্রোজেন, নাইট্রোজেন থেকে কার্বন। এই কার্বন যখন পানি বায়ু ও মাটির সংস্পর্শে আসে তখন ডিএনএ (উঘঅ) গঠন করে। ডিএনএ থেকে আকার সৃষ্টি হয়। উঘঅ এর শক্তি ও কার্যকারিতা অনুসারে মানবদেহসহ বিভিন্ন জীব সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানিরা এর নাম দিয়েছেন প্যানস পারমিয়া থিওরি।
আবার সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে – পিতার অগ্নিতত্ত্ব ও মাতার সোমতত্ত্বের সমন্বয়ে সন্তান জন্ম হয়। সোমতত্ত্বকে (পানি) প্রভাবিত করে চন্দ্র।
ইসলাম ধর্ম মতে– পানিকে নিয়ন্ত্রণ করেন হজরত খিজির (আ.)। হজরত খিজির (আ.)’র সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক। আবার জ্ঞানের সাথে পানির সম্পর্ক। এজন্য সাধককদের অনেক সময় পানির সংস্পর্শে থাকতে দেখা যায়। কারণ পানি জ্ঞান বৃদ্ধি করে, ব্যক্তিত্বকে নির্মাণ করে। পানির সংস্পর্শ ব্যতীত অতীন্দ্রিয় জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। চন্দ্র প্রকৃতিসহ মানবদেহে পানির ভারসাম্য রক্ষা করে। চন্দ্রের প্রভাবে সমুদ্রে জোয়ার ভাটা হয়। চন্দ্রের উপর নির্ভর করে মহিলাদের ঋতুচক্র সংগঠিত হয়।
প্রাণহীন দেহের যেমন কোনো মূল্য নেই, তেমনি রবির প্রভাব ছাড়া প্রকৃতি অস্তিত্বহীন। রবির (আলো) প্রভাবে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য সূর্যের আলো প্রয়োজন। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৃক্ষ অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আর এই অক্সিজেন হল মানবসহ প্রাণীকুল বেঁচে থাকার প্রধান আহার। এজন্য বৃক্ষকে প্রকৃতির প্রাণ বলা হয়। যেহেতু রাতে সূর্যের আলো থাকে না, তাই রাতে বৃক্ষ অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারে না। সূর্যব্যতীত প্রকৃতিও এক রকম নিস্তেজ। এজন্য আল্লাহ রাতকে সৃষ্টি করেছেন বিশ্রামের জন্য। আবার দিনে রবির প্রভাবে প্রকৃতি যেন এক রকম প্রাণ ফিরে পায়। কারণ রবি প্রাণশক্তির কারক। এজন্য আল্লাহ দিনে কর্ম করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সূর্য প্রাণশক্তির উৎস বিধায় প্রাচীন ঋষিগণ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে গোবর্ধন পূজা করতেন। গো অর্থ আলো আর বর্ধন অর্থ বর্ধিতকরণ। অর্থাৎ আলোর বর্ধিতকরণ। কারণ পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে সূর্যের প্রভাব দেহে বেশি অনুভব হবে (এই বিষয়ে ধর্মের হয়ত আরও বিভিন্নব্যাখ্যা থাকতে পারে বা আছে, এ নিয়ে আমার কোনো মতবিরোধ নেই)। সূর্যের (রবি) প্রভাবে পৃথিবীতে ভাষার উৎপত্তি হয়। সূর্যের আলোর গতি থেকে সুরের উৎপত্তি। সুর দেয় বলে ঋষিগণ এর নাম দিয়েছেন সৌরীয়া। পরবর্তীতে সুর থেকে মানুষ্য ভাষার সৃষ্টি হয়। এক কথায় বলা যায় সূর্য ও চন্দ্রের প্রভাবে প্রকৃতি ও মানব জীবনের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাজ্জাদানশীন– মতি ভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।