শহরের গৃহবন্দীত্বে আর চার দেয়ালে ঘেরা মাঠহীন শিক্ষালয়ে দীক্ষা নিয়ে আমাদের সন্তানেরা ঠিক কতটুকু শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তা জানি না। শিক্ষা শুধু বই মুখস্থ করে পুঁথিগত বিদ্যা লাভ করে অর্জনের বিষয় নয়। বই পড়ার পাশাপাশি পরিবেশ প্রকৃতির দর্শনে এবং সমাজের সংগতি অসংগতি আবলোকনে নিজের মনোজগতকে শুদ্ধ অশুদ্ধ আলাদা করার ক্ষমতা অর্জনই প্রকৃত শিক্ষা। আজকাল শিশুরা যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমাদের সময়টাতে নদীতে নৌকা আর জলের আয়নাবাজি দেখে, পথেঘাটে নানান মানুষের আচরণের ভিন্নতা লক্ষ্য করে মেঠোপথে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথেই অনেককিছু শেখা হয়ে যেত। ছুটির পর ঘুঘুর ডাকা দুপুরে চোরকাটা মাড়িয়ে কাশবন পেরিয়ে নদীপাড়ের বাদামক্ষেতের কাঁচাবাদাম চিবিয়ে সবুজ ধানের ক্ষেতে কিংবা হলদে ফুলের সর্ষের মাঠে আলপথ ধরে হেঁটে উন্মাদ বাতাসে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে সবুজের সুগন্ধি টেনে নিয়ে প্রকৃতির যে পাঠ পড়েছি, তা এখনকার শিশুদের শিখবার সময় কিংবা সুযোগ কোনোটাই নেই। কারণ, তখনকার সময়ে বাবা মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে আতঙ্কিতও ছিল না। সমাজ ছিল সহজ সরল মানুষের অভয়ারণ্য। তখন বাচ্চার হাত ধরে নিয়ে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে মায়েরা পেপার বিছিয়ে ফুটপাতে বসে স্কুল ছুটির অপেক্ষা করতো না। স্কুলের পর কোচিং সেন্টারের দিকেও নিয়ে ছুটতো না। বাচ্চাদেরকে মায়েরা সারাক্ষণ সাথে থেকে পাহারাও দিতে হতো না। এখন যা হয় বা হচ্ছে তা কিছুটা প্রতিযোগিতা আর কিছুটা অবক্ষয় হয়ে যাওয়া সমাজের কালো থাবা থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টাতেই হচ্ছে। এতে একদিকে বিপদ থেকে সন্তানকে সুরক্ষা দিয়ে পুঁথিগত বিদ্যায় উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি হলেও অন্যদিকে আমাদের সন্তানদের মনোজগৎ সংকীর্ণ হচ্ছে। ছোটো হয়ে যাচ্ছে তাদের সৃজনশীল কল্পরাজ্য।
অথচ, রাতে খোলা উঠোনে শীতল পাটিতে হারিকেনের মৃদু আলোয় বসে বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আকাশের তারা গুনে কখনো আবার দাদীর মুখে চাঁদের বুড়ির গল্প শুনে আমরা ঘুমাতে যেতাম। ঘুমের আগে চোখে কল্পনায় কত ছবি আঁকতাম! ডাহুকীর কান্না, শিয়ালের হাঁক, আর কানাকুয়োর ভয়ংকর ডাকে আমরা রাতের আঁধার প্রকৃতির রূপের ভিন্নতা দেখে নিজের ভিতরে সৃষ্টি করেছি বিশাল এক কল্পরাজ্য। কিন্তু এখনকার বাচ্চারা ফ্ল্যাটের ছোটো স্ট্যাটিরুমে বসে কেবল বইয়ের পৃষ্ঠা মুখস্ত করে শেখা বিদ্যায় আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে মোবাইল ফোন ঘেটে কতটুকুই বা শিখে! পাহাড়ের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া মেঘের সারি, নদীর কলতান কিংবা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন যা শেখায়, সেই শিক্ষা শহুরে বিদ্যালয়ের এসির কক্ষে নেই। প্রকৃতিই বিধাতার সৃষ্টি এক বিরাট পাঠশালা! প্রকৃতির শিক্ষাই মূলত মানুষকে মানবীয় হতে শেখায়। তাই আসুন, আমাদের সন্তানদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে প্রকৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেই। মুখস্ত বিদ্যার পাশাপাশি সুপ্ত কল্পরাজ্যের সাথে পরিচিত করে তাদের মনে ও মগজে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাই। তবেই তারা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয়ে উঠবে।