প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য : যা মানুষের মনোজগতকে রাঙিয়ে তোলে

ঝর্না বড়ুয়া | সোমবার , ১৭ মে, ২০২১ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

আমরা মানুষরা কত সৌভাগ্যবান জন্ম থেকে প্রকৃতি থেকে শিখে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বেড়ে উঠে এ জগৎকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। কিনু্ত এই প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সৌরভ কতখানি অন্তরে ধারণ করি তা আজ বড় প্রশ্ন হয়ে মানব সভ্যতার কাছে ধরা দিয়েছে! পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যের রূপ ধরা দেয় একমাত্র মানুষের মনে ও চোখে। মানুষের চোখকে মোহিত করে আর মনকে দোলা দেয় এই প্রকৃতি। মানব মন ছুটে চলে দিক থেকে দিগন্তে পৃথিবীর রূপ দর্শনে। পৃথিবীর নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কোথাও সুউচ্চ পর্বতমালা বরফে ঢাকা, কোথাও রাশি রাশি জলকণা সমুদ্র ও আকাশের নীলকে মিলেমিশে একাকার করে তোলে, অন্যদিকে একাধিক রঙ ও বর্ণের সবুজ বন এবং গাছপালা যা আকাশ ছুঁয়ে যায় নিমিষে, সেই পাহাড় থেকে কলকলে শব্দে ও ছন্দে নেমে আসে পাহাড়ি ঝর্ণা অনবরত আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ছুটে চলে নদী থেকে সাগরে আরো রয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, জলপ্রপাত, গিরিখাত, মাটির নীচে নানা খনিজ সম্পদ, লাল মাটির পাহাড় পর্বত, সমুদ্রের তল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভার আরো কত অজানা পৃথিবীর সৌন্দর্য – যা প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে মানুষের মনোজগতকে। এরূপ মহিমান্বিত সৌন্দর্যের রূপ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না এক জীবনে।
কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত। যা ১২২ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত। কঙবাজার নামটি এসেছে ক্যাপ্টেন হিরাম কঙ নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক নাম থেকে। এক সময় কক্সবাজার পানোয়া নামেও পরিচিত ছিল যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে হলুদ ফুল। কক্সবাজার আগের নাম ছিল পালন্‌কী। এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র ফিস একুরিয়াম। আরো রয়েছে প্যারাসেলিং, ওয়াটার বাইকিং, বিচ বাইকিং, কঙ কার্নিভাল, সার্কাস শো, দরিয়ানগর ইকোপার্ক, ফিউজার পার্ক, শিশুপার্ক এবং অন্যান্য ফটোস্যুাট স্পট ও টেকনাফ জিওলজিক্যাল পার্ক। এখানে উপভোগের জন্য রয়েছে নাইট বিচ কনসার্ট। কক্সবাজারে নির্মিত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সী একুরিয়াম। ক্যাবল কার এবং ডিজনি ল্যান্ড।লাবণী পয়েন্ট, হিমছড়ির অপরূপ একদিকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত ঝর্ণা, ক্রিসমাস ট্রি, সমুদ্রের নীল জলরাশি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য প্রধান আকর্ষণ এবং ইনানী সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার পানির জন্য জায়গাটি পর্যটকদের কাছে সমুদ্রস্নানের জন্য উৎকৃষ্ট। কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে একটি শহর, পর্যটন কেন্দ্র ও নৈর্সর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
প্যাংগং লেক, লাদাখ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত মরুভূমি আর পাহাড়বেষ্টিত এক প্রাকৃতিক নিঃসর্গ। এটি ভারত ও চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চল লাদাখে অবস্থিত। এটি একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে।
তারার সাগর বলা হয় ভাদো দ্বীপকে যা মালদ্বীপে অবস্থিত। সূর্য ডুবতেই এই দ্বীপের সমুদ্রতট ভরে ওঠে আলোয়। দেখে মনে হয়, আকাশ থেকে তারা খসে পড়ছে এই সমুদ্রে আর সমুদ্র ঢেউ সেই তারাগুলো ভাসিয়ে এনে জড়ো করছে তীরে। তাই একে বলা হয় তারার সাগর। সমুদ্রের নীল ঢেউয়ে ভাসতে থাকা এই তারাগুলো আসলে জৈবিক আলো। এগুলো ক্ষুদ্রাকৃতি প্লান্‌কটন। যেগুলো রাতের আঁধারে জ্বলজ্বল করে। সামুদ্রিক প্লান্‌কটনগুলো নীল রঙের দ্যূতি ছড়ায়।
আলোর স্তম্ভ বা লাইট পিলার বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বিস্ময়। পুরো আকাশ জুড়ে একাধিক আলোর স্তম্ভ। মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়েছে এই চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ধরা পড়ে মস্কোতে এই আলো ছুটে আসে সূর্য বা চাঁদ থেকে। লম্বালম্বিভাবে সেই আলো আকাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়,স্বচ্ছ আকাশে এই দৃশ্য মানুষকে হতবাক করে দেয়।এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে মস্কোতে প্রতি বছর লাখো মানুষ জড়ো হন। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই আলোয় পিলারগুলো বেশির ভাগ দেখা দেয়। পুরো শহর আলোকিত হয়ে ওঠে এই পিলারগুলোর আলোতে।
ভাতানুকূল ন্যাশনাল পার্ক আইসল্যান্ড ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ড প্রাকৃতিকভাবেই মনোমুগ্ধকর বিশ্বের আশ্চর্যজনক স্থানগুলোর বেশ কয়েকটি রয়েছে এ দেশে। সেসব স্থানের অন্যতম দেশটির ভাতানুকূল ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে রয়েছে বিশ্বের বৃহৎ হিমবাহগুলোর একটি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য বরফের গুহা।এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জকুলসালগজুফুর ও সাকাফাফেল ন্যাশনাল পার্ককে এক সঙ্গে করে দেওয়া হয়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় পার্ক। ১২ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। খরস্রোতা নদী, জমে থাকা বরফ, আগ্নেয়গিরি এবং ভূতাত্ত্বিক পরিবেশ এই পার্ককে অনন্য করে তুলেছে। বিশ্বের আলোকচিত্রীদের কাছে এই পার্কটি স্বপ্নের মতো এক অসাধারণ মুগ্ধতায়ভরা।
গোলাপি হ্রদ, অস্ট্রেলিয়া পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগে একটি হ্রদ রয়েছে যার পানির রং গোলাপি।এই হ্রদটির নাম হিলিয়ার হ্রদ বিশেষ কোন সময়ে নয় স্থায়ীভাবেই এই হ্রদের পানির রং গোলাপি।
সালার দে উয়ুনি পৃথিবীর বৃহত্তম আয়না। বর্ষাকালে বলিভিয়ার বৃহত্তম এই লবণভূমি বিশাল এক প্রাকৃতিক আয়না তৈরী করে। লবনের এই আশ্চর্য মরুভূমিকে দেখার জন্য প্রতিবছর ছুটে আসে হাজার হাজার পর্যটক।
অরোয়া অনেকে বলেন মেরুজ্যোতি বা মেরু প্রভা, অরোয়া মেরু অঞ্চলের আকাশে বাহারি আলোকছটা, বায়ুমণ্ডলের থার্মোকিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমানুর সঙ্গে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত কনিকাসমূহের সংঘর্ষের
ফলেই অরোয়া তৈরী হয়। সবচেয়ে স্পট অরোয়া দেখা যায় আলাস্কা, কানাডা এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অঞ্চল, কানাডিয়ান সীমান্ত, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরসীমায় কয়েকবার অরোয়া দেখা যায়। গ্যান্ড ক্যানিয়ন গিরিখাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলংকার। এখান থেকেই বয়ে যেত খরস্রোতা কলোরোডা নদী। এই গ্যান্ড ক্যানিয়ন প্রায় ২৭৭ মাইল লম্বা ও প্রায় ১৮ মাইল প্রস্থ এবং এ গভীরতা প্রায় এক মাইল। এই গিরিখাতটা এক সময় পানির নীচে ছিল। এর জন্ম প্রায় দুই বিলিয়ন বছর আগে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম গিরিখাত।
নায়াগ্রা জলপ্রপাত উত্তর আমেরিকার নায়াগ্রা গিরিখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নায়াগ্রা নদী নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্টারিও কানাডার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নায়াগ্রা জলপ্রপাত অবস্থিত। মূলত তিনটি পাশাপাশি ভিন্ন জলপ্রপাত নিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত গঠিত। এর তিনটি জলপ্রপাতের নাম কানাডা ফলস, আমেরিকান ফলস এবং ব্রাইডাল ডিল ফলস। Onguiaahra শব্দ থেকে নায়াগ্রা কথাটির উৎপত্তি যার অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। আমেরিকাতে জলপ্রপাতটি পিছন থেকে দেখতে হয়। কানাডাতে সরাসরি সামনে থেকে দেখা যায়, ফলে সম্পূর্ণ জলপ্রপাত ভালোমত দেখা যায়। কানাডা ফলস প্রায় ৫৩ মিটার উঁচু এবং ৭৯২ মিটার চওড়া। আমেরিকান ফলস ২১ মিটার লম্বা এবং ৩২৩ মিটার চওড়া। বসন্তের শেষের দিকে বা গ্রীষ্মকালের শুরুতে জলপ্রপাতগুলো থেকে সেকেন্ডে ২০,২০,০০০ ঘনমিটার পানি পতিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পর্যটকদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। নায়াগ্রার সৌন্দর্যে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যের এক প্রাকৃতিক জলপ্রপাত।
উপরের অপরূপ সৌন্দর্যসহ হাজারো হাজারো প্রকৃতির অপরূপ রূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সমগ্র বিশ্বজগতে। সৌন্দর্যের এ বৈচিত্র্য পৃথিবীকে করেছে আকর্ষণীয় ও মহিমান্বিত। মানুষ বেঁচে থাকার অনন্য ঠিকানা। মানবসমাজ এই অনবদ্য রূপ উপভোগ করার জন্য ছুটে চলে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কখনো কখনো সেই সৌন্দর্য হয়ে উঠে বর্ণনাতীত চোখ ধাঁধানো এবং মন ছুঁয়ে যায় অনেকসময় আবেগে আপ্লুত করে। পৃথিবীর নানাপ্রান্তের এ মনকাড়া প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের মনকে মুগ্ধ ও আনন্দিত করেছে নিঃসন্দেহে। তাই সকলের উচিত প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং প্রকৃতির সর্বোত্তম পরিচর্যা করা।
এখানে উল্লেখ করা যায়, একজন রাজপুত্র হয়েও মহামতি গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ ও মহাপরিনির্বান লাভ সবটায় প্রকৃতির মধ্যেই বৃক্ষের ছায়াতলে এবং তিনি সমাজ জীবনের একটি শ্রেণীকে (ভিক্ষু সংঘ) বৃক্ষ কাটতে নিষেধ করেছে। মহামতি বুদ্ধ তাঁর ৪৫ বৎসর প্রচারিত ধর্মে সর্বপ্রাণীর সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেছিলেন। শুধু মানব জীবনের নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও ক্ষমা পোষণ করেছিলেন। তিনি প্রাণীর প্রতি দয়া বা প্রেম থেকে সেই যুগে ‘প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকার’ যে নীতি দিয়েছেন তা বর্তমান বিশ্বের শিক্ষণীয় ও গ্রহণীয়। প্রাকৃতিক পরিবর্তন ধারাকে উদাহরণ দিয়ে বহু শিক্ষা দিয়েছেন মানব জীবনকে উন্নত করতে। জন্ম থেকে মহাপরিনির্বাণ সময় পর্যন্ত সারা জীবন নির্জন বনে ও পাহাড়ে অতিবাহিত করেছেন। তাঁর এ শিক্ষা এখনো আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক। তাঁর এ জীবন দর্শন থেকেও প্রকৃতির জয়গান প্রকাশ পায়। সনাতনধর্মে তুলসীগাছের পূজাসহ বহু বৃক্ষ পূজা ও প্রকৃতির পূজা করে আসছে আবহমান কাল থেকে, খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক প্রভু যীশুখ্রিষ্ট, ইসলাম ধর্ম প্রচারক নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) প্রকৃতির মহাগুণ বর্ণনায় বলেছেন, এই মহাবিশ্বের প্রতিটি সৌন্দর্যই ‘সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’ ।
আজ আমরা যে কঠিন কোভিড ১৯ মহামারীতে পুরো বিশ্ব আতঙ্কিত তার থেকে উত্তোরনের একমাত্র উপায় প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক জীব জগৎকে সংরক্ষণ করা। যা সমগ্র জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র সবুজ ভূপৃষ্ঠ। এ ভূপৃষ্ঠকে সঠিকভাবে লালনপালন, সেবাযত্ন ও ভালোবাসায় সবুজায়নে আবৃত করে গড়ে তুলতে হবে আমাদেরই ফুসফুসকে সজীব, সক্রিয় এবং মানব জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে। সর্বশেষে বলতে চাই, আসুন প্রকৃতিকে আপন করে ভালোবেসে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করি, তাতে মানব সভ্যতার জন্য এ সুন্দর পৃথিবী আরো ভালোবাসাময় হয়ে উঠবে। ‘বিশুদ্ধ অঙিজেনের’ যেন অভাব না হয় তাই বেশি বেশি গাছপালা লাগাই, প্রাণী জগৎকে সংরক্ষণ করি, পরিবেশকে দূষণমুক্ত করি। বিশুদ্ধ আলো, বাতাস, পানির চাহিদা নিশ্চিত করি ও সচেতন হয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করি। প্রকৃতি আর মানুষ তো অভিন্ন এই পৃথিবীর সৃষ্টি লয়ে তাই বারেবারে মন ছুঁয়ে যাওয়া সেই রোমান কবিতায় বলি -‘একই আকাশ, সূর্য আর চাঁদের/ আলোর নীচে আমাদের বসবাস/ দিন শেষে আমরা তো একই সাগরের ঢেউ।’
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের সবাইকে যে কোনো মূল্যে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকানের পর্দা প্রতিস্থাপন : যুগান্তকারী মাইক্রোসার্জারী