বছরে ৬শ কোটিরও বেশি টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের সার পরিবহন ও সংরক্ষণে সুবিধা নিশ্চিত করতে গৃহীত একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। প্রকল্প ব্যয় এবং সময় বাড়িয়েও কাজে কোন গতি আনা সম্ভব হয়নি। ৩৪টি গুদামের মধ্যে ১০টি গুদামের জায়গাও এখনো পাওয়া যায়নি। দেশের সার সংকট মোকাবেলা এবং কৃষিখাতের উৎপাদনকে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে দেশের বিভিন্নস্থানে ৩৪টি সারের বাফার গুদাম নির্মাণের প্রকল্পটির বেহাল দশা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের কৃষি উৎপাদনের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে রাসায়নিক সার। বিদেশ থেকে চড়া দামে সার আমদানি করে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে সাধারণ কৃষকদের মাঝে বিক্রি করে। বিদেশ থেকে সার আনার পর তা গুদামে রাখা হয়। দেশে বর্তমানে ২৫টি বাফার গুদাম রয়েছে। যেখানে সার সংরক্ষণ করে সুবিধামতো সময়ে বিক্রি করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, কৃষির ভর মৌসুমে বিদেশ থেকে চড়াদামে সার আমদানি করতে হয়।
যদি অফ সিজনে সার আমদানি করা যেতো তাহলে বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। কিন্তু অফ সিজনে সার আমদানি করলে তা সংরক্ষণ করার মতো গুদাম দরকার। দেশে বর্তমানে ২৫টি বাফার গুদামের সাধারণ ধারণক্ষমতা ১.৪৫ লাখ টন এবং ঠাসাঠাসি করে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ২.৯৩ লাখ টন। এই ২৫টি গুদাম থেকে প্রতিবছর ১৭ লাখ ১৮ হাজার টন ইউরিয়া সার দেশের কৃষি সেক্টরের জন্য সরবরাহ দেয়া হয়। কিন্তু গুদাম না থাকায় সস্তা সময়ে আরো বেশি সার কিনে মজুদ রাখার সুযোগ বাংলাদেশের নেই।
যদি অফ সিজনে সার কিনে মজুদ রাখা সম্ভব হতো তাহলে সরকারের বছরে অন্তত ৬শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো বলে মন্তব্য করে কৃষি অধিদপ্তরের পদস্থ একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অফ সিজনে সার কেনার কথা বাদ দিলেও আমাদের প্রয়োজনও এই ২৫টি গুদাম মিটাতে পারছে না। প্রতি বছর আমাদের হাজার হাজার টন সার খোলা আকাশের নিচে সংরক্ষণ করে সরবরাহ করতে হয়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদামগুলোর বাইরে খোলা আকাশের নিচে অন্তত ৯ লাখ টন সার সংরক্ষণ করতে হয়। এতে বড় ধরণের ঝুঁকির পাশাপাশি সারের গুণগতমানও নষ্ট হয়ে যায়।
ইউরিয়া সার সংরক্ষণ ও বিতরণের বিরাজমান সংকটের মাঝে সরকার দেশের নানাস্থানে আরো ৩৪টি বাফার সার গুদাম নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ৮ লাখ টন ইউরিয়া সারের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এসব গুদামের নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০২১ সালের জুন মাসেন মধ্যে ৩৪টি বাফার গুদামের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২১ সালে প্রকল্পের অতি নগন্য কাজই সম্পন্ন হয়েছে।
পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেই মেয়াদও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২২৫ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। শুরুতে ১ হাজার ৯৮৩ কোটি ৪ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে প্রকল্প ব্যয় ৪৮৫ কোটি ৪৮ লাখ বৃদ্ধি করে ২ হাজার ৪৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। এই ব্যয় আরো বাড়বে বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, প্রকল্পটি গতি পাচ্ছে না। শুরু থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কবলে পড়ে। এতে করে ৩৪টি গুদামের ২৪টিতে টুকটাক কাজ হলেও ১০টি গুদামের জায়গাই চিহ্নিত হয়নি। প্রকল্পটির আওতায় কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জের সদর, কাজীপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা , মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে বাফার গুদাম নির্মাণের কথা। গুদামগুলো নির্মিত হলে বিসিআইসির বছরে অন্তত ৬শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্র মাত্র ৪ বছরের মাথায় প্রকল্পের ব্যয় উঠে আসবে বলে মন্তব্য করে বলেছেন, সবচেয়ে বড় অর্জন হবে দেশের সারের নিরাপত্তা।