পোশাক শিল্প : সংকট-ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন দরকার

| শনিবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:২৬ অপরাহ্ণ

দেশের প্রধান রফতানি খাত হিসেবে পরিচিত পোশাক শিল্প বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এবং ক্রয়াদেশে মন্দাভাবের কারণে এই খাতে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। উদ্যোক্তা থেকে শ্রমিকসবাই এক অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উৎপাদনশীল কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। ফলে কর্মসংস্থানে নেমে এসেছে খরা। অন্য দিকে নতুন উদ্যোক্তাও কম। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকই ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

এদিকে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশের ৪০০টি পোশাক কারখানা ব্যাংকিং সমস্যার কারণে বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। শিল্পসংশ্লিষ্ট পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি বিজিএমইএর এক মতবিনিময় সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় অংশগ্রহণ করা ৭০টিরও বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুসরণ করে খেলাপি ঋণ নীতিমালার মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছরে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া সভায় দীর্ঘদিন ধরে রুগ্‌ণ হয়ে থাকা ৭৭টি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানানো হয়। বিজিএমইএর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৭ সেপ্টেম্বর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে ব্যাংকিং সমস্যা নিয়ে সদস্যদের এক গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সভাপতিত্বে ৭০টিরও বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সংগঠনের সহসভাপতি মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী, পরিচালক ফয়সাল সামাদ এবং বিজিএমইএর এক্সিট পলিসিসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম ও ওয়ান স্টপ সেলসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।

সভার মূল আলোচনার মধ্যে অন্যতম ছিল খেলাপি ঋণ নীতিমালা। এ প্রসঙ্গে সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সার্কুলারের অধীনে খেলাপি ঋণ নীতিমালার মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছরে উন্নীত করার প্রস্তাব করেন। তারা জানান, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ সংক্ষিপ্ত সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এছাড়া ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট কমানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয়। ফোর্সড লোন ও মামলার বিষয়ে সভায় সদস্যরা জানান, নিয়মবহির্ভূত কারণে ফোর্সড লোনের শিকার হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান চেক ডিজঅনার ও অর্থঋণ মামলার মতো জটিলতার শিকার হচ্ছে, যা তাদের কার্যক্রমকে আরো বাধাগ্রস্ত করছে। তারা এ পরিস্থিতি নিরসনে বিজিএমইএ বোর্ডকে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান।

সহনশীল এক্সিট পলিসি নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা একটি সহনশীল এক্সিট নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, এটি ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সম্মানের সঙ্গে ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেবে।

নীতি সহায়তার বিষয়ে সভায় সদস্যরা মতামত দেন যে দেশের অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতি সহায়তা দিচ্ছে, তা যেন শুধু বড় রফতানিকারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোও যেন এ সুবিধা পায়, সে ব্যাপারে জোরালোভাবে আহ্বান জানানো হয়।

সভায় পোশাক খাতে দীর্ঘদিন ধরে রুগ্‌ণ হয়ে থাকা ৭৭টি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানানো হয়। বিজিএমইএ কর্মকর্তারা বলেন, ‘এই ব্যাংকিং সমস্যাগুলো শুরু হয়েছে মূলত কোভিডকাল থেকে। সেই সময়ে শুরু হয়ে কোভিডপরবর্তীতে রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও রয়েছে। তারপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গেছে ২০২৪ সালে। ওই সময়ও কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। সব মিলিয়েই সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে।’

তাঁরা আরো বলেন, বর্তমানে দেশের মোট ১৯টি ব্যাংকে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। দেখা গেছে, আমাদের পণ্য রফতানির বিপরীতে প্রাপ্য অর্থের একটি নথি বাংলাদেশে আসছে, আর অর্থগুলো আমদানির বিপরীতে দেশের বাইরেই সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে। সভায় বলা হয়, নীতি সহায়তা পেলে বন্ধ ৪০০ কারখানা পুনরায় চালু হয়ে অতিরিক্ত এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে, যা প্রতি বছর গড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকযার বেশির ভাগই নারীএই খাতে কর্মরত। ফলে এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই খাতে চলমান সংকট অব্যাহত থাকলে শুধু রফতানি আয় নয়, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়বে। সরকারের উচিত হবেসংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি সংকট ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে