আমাদের দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ। কিন্তু সেই পোশাক শিল্পে চলছে অস্থিরতা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে আতঙ্ক–উদ্বেগ যেন কাটছেই না। একের পর এক সৃষ্টি হচ্ছে নতুন অস্থিরতা। গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভ, কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চলছে ধারাবাহিকভাবে। গত কয়েকদিন শিল্প মালিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক দফা বৈঠকের পর কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সংগঠন (বিজিএমইএ)। তবুও অস্থিরতা না থামায় আতঙ্ক কাটেনি শিল্প মালিকদের মনে। এ অবস্থায় গত শনিবার কারখানা খোলা থাকলেও অনেক শ্রমিক এসে কাজ করেননি। আবার অনেক কারখানায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খোঁজ মেলেনি। কেউ কেউ ভয়ে কারখানাই খোলেননি। এর মধ্যে গত শনিবার সেনাবাহিনী, শিল্পপুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও কারখানার মালিকদের সমন্বয়ে এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রবিবার থেকে আশুলিয়ার সব কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, হঠাৎ করেই তৈরি শিল্প শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এমন কিছু দাবি উঠছে, যা এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পোশাক শ্রমিকদের একটি পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা সমান হতে হবে। এছাড়া, গত জানুয়ারি থেকে নতুন মজুরি কাঠামো মেনে নিয়েই কাজ চলছে, সাত মাস যেতে না যেতেই বেতন বাড়ানোর দাবি উঠছে, মজুরি কাঠামোতে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে, এবার সেই বেতন বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কথা বলা হচ্ছে, এমন কথাও কেউ কখনো শোনেনি। হঠাৎ এমন দাবি নিয়ে বিস্মিত খাত সংশ্লিষ্টরা। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ও শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলন থামাতে আমরা কাজ করছি। তাদের কোনো যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট দাবি নেই। শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বসেছি, তারাও বলছে সুনির্দিষ্ট দাবি নেই। তারপরও কিছু আন্দোলনের চেষ্টা হচ্ছে। এর মধ্যে আর্মি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, কারখানার মালিকদের সমন্বয়ে আমরা একটি এক মতবিনিময় সভা করেছি।
পোশাকশিল্পের উন্নয়নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার খুব আন্তরিক বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদেরকে জাতি পুনর্গঠনে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন অল্প কিছুদিন আগে। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ভগ্ন অর্থনীতি পেয়েছে এবং তারা এখন দেশকে ঠিক করার এবং একে প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার কঠিন কাজের সম্মুখীন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে গেছে। আমরা একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়েছি। তারা আমাদেরকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে গেছে। কিন্তু সবার সহযোগিতায় আমরা দেশকে পুনর্গঠন করতে পারব। ১৫ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব কথা জানা যায়। এতে আরো জানা যায়, জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বকে পূর্ণ সমর্থন করেন। তাঁরা এ খাতের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানান। তাঁরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহায়তা কামনা করেন। তাঁরা শিথিল ঋণ পরিশোধ এবং ইউটিলিটি বিল পরিশোধসহ কয়েকটি দাবি উপস্থাপন করেন। অধ্যাপক ইউনূস ধৈর্য সহকারে তাঁদের কথা শোনেন এবং তাঁদের দাবিগুলো বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমরা প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব। বাংলাদেশের জনগণের অসীম প্রতিভা রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আমরা চাই এটি আরো প্রসার লাভ করুক।’
ক্ষতি কাটিয়ে উঠে গার্মেন্টশিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখনই আবার এ শিল্পে অসন্তোষ শুরু হয়। বিক্ষোভ ও হামলার কারণে সব মিলে প্রায় দুশ শিল্পকারখানায় বন্ধ ছিল। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, বস্তুত দেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্যতম হলো পোশাকশিল্প। কাজেই এ শিল্পের স্বাভাবিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, তার সবই সরকারকে করতে হবে।