১৯৭১ সনে পেন্টাগনের শীর্ষ গোপন দলিল ‘পেন্টাগন পেপারস’ সংবাদপত্রে ফাঁস হয়। যা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অত্যন্ত গোপন ও ব্যাপক গবেষণার দলিল। এর জন্য অভিযুক্ত হন ডেনিয়েল এলসবার্গ। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, জনমতাধিকারিক, সামরিক বিশ্লেষক ও গবেষক। আমেরিকার বিখ্যাত থিংকটেংক রেনড কর্পোরেশনের এনালিস্ট। একজন হার্ভাড পিএইচডিধারী তার স্পেশালাইজেশন ছিল অনিশ্চয়তা আর অস্পষ্টতার মাঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম, যা পরবর্তীকালে ‘এলসবার্গ পেরাডঙ’ নামে খ্যাত। অনেকদিন তৎকালীন সেক্রেটারী অব ডিফেন্সের বিশেষ সহকারী রূপে কাজ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় দুবছর আমেরিকান বাহিনীর সাথে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন। তিনিই প্রথম বের করেন কিভাবে মিথ্যা নৌআক্রমণের অপবাদ দিয়ে আমেরিকা সরাসরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়ায়। যা শুরুতে ছিল গৃহযুদ্ধ দুই উপনিবেশিক শক্তির সংশ্লিষ্টতায়।
এই ফাঁস আমেরিকার গণমতে তোলপাড় আলোড়নের ঢেউ ওঠে। তার বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে আমেরিকার এসপাইওনেজ এক্ট ১৯১৭ অনুযায়ী গুপ্তচরবৃত্তি, দলিল চুরি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। এই আইন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকার সরকারি কর্মীদের জন্য প্রণীত হয় যাতে আমেরিকার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো তত্ত্ব বা তথ্য শত্রু পক্ষের হাতে না পরে। প্রসঙ্গত অভিবাসীদের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তখন অনেক জার্মানরা ছিল।
৩ জানুয়ারি ১৯৭৩ ডেনিয়েল এলসবার্গকে ফেডারেল কোর্ট ১১৫ বছর জেল শাস্তি দেয়। কিন্তু ১১ মে ১৯৭৩ তারিখে আমেরিকার সুপ্রিমকোর্ট তাকে সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। যুক্তিগুলো ছিল সরকারি কার্যধারায় অসদাচরণ ও বেআইনীভাবে প্রমাণ সংগ্রহ। তারসাথে হারভার্ড আইনস্কুলের অধ্যাপক চার্লস নেসন ও কৌসুলী লিউনার্ড বউডিনের অকাট্য শুনানি।
আত্মপক্ষ সমর্থনে ডেনিয়েল এল্সবার্গ যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা কল্যাণের জন্য সত্য উদ্ঘাটনের এক চির সমুজ্জ্বল মেগনাকার্টা। দও ভবষঃ ঃযধঃ ধং ধহ অসবৎরপধহ পরঃরুবহ, ধং ধ ৎবধংড়হধনষব পরঃরুবহ, ও পড়ঁষফ হড় ষড়হমবৎ পড়ড়ঢ়বৎধঃব রহ পড়হপবধষরহম ঃযরং রহভড়ৎসধঃরড়হ ভৎড়স ঃযব অসবৎরপধহ ঢ়ঁনষরপ. ও ফরফ ঃযরং পষবধৎষু ধঃ সু ড়হি লবড়ঢ়ধৎফু ধহফ ও ধস ঢ়ৎবঢ়ধৎবফ ঃড় ধহংবিৎ ঃড় ধষষ পড়হংবয়ঁবহপবং ড়ভ ঃযরং ফবপরংরড়হ্থ. (আমি মনে করি একজন আমেরিকান নাগরিক হিসাবে, একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হয়ে, আমি আমেরিকার জনগণের নিকট হতে তথ্য লুকানোর হীন কাজে আর সহযোগিতা করতে পারি না। আমি সজ্ঞানে স্পষ্টতই নিজের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেছি এবং এজন্য সব পরিণামের প্রত্যুত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত)।
তার এই কাজের জন্য আমেরিকা সরকারের অনেক খারাপ অকল্যাণকর উদ্যোগ পরিত্যক্ত বা প্রতিহত হয়। মেধা ও প্রজ্ঞার সমম্বয়ের সাহসী বুদ্ধিগত পদক্ষেপের জন্য তাকে ‘রাইট লাইভলিহুড এয়ার্ড ২০০৬’ ও ‘অলোফ পালমি প্রাইজ ২০১৮’ দেয়া হয়। এসব অর্পনে সাইটেশন ছিল,’ প্রগাঢ় গভীর মানবতা বোধ ও অসাধারণ ব্যতিক্রমী নৈতিক সাহসিকতা’। তার এইসব কাজের উদাহরণ ডিসিশন থিয়োরীতে সংযুক্ত করা হয়। আমি তখন মেডিকেলের ছাত্র। আমার বিচারক পরে আইনজীবী বাবার কাছে এসব শুনতাম। নিউজউইক, টাইমস মেগাজিনে বর্ণনা আসতো। বাবা বলতেন বার, বেঞ্চ, শিক্ষক, ডাক্তার আর সাংবাদিকদের সারাক্ষণ গণ্ডির বাইরের পড়াশুনা আর চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত রাখতে হয়। তা নাহলে সত্য সুন্দর কল্যাণকে পরাভব মানতে হবে অসত্য অসুন্দর অকল্যাণের কাছে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নিয়ে যা হচ্ছে তার সাথে পেন্টাগনের গোপন দলিল ফাঁসের কি অদ্ভূদ মিল। এ কদিন কাউকে এই ঘটনা মনে করতে দেখলাম না। সেই প্রেক্ষাপট, অসদোপায়ে প্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টা, বস্তাপচা আইনের অনুপযুক্ত প্রয়োগ, আর আমলাদের মরিয়া হয়ে যাওয়া। ওখানে ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর এখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দুটোই তথ্য যুদ্ধ। বাবা বলতেন যেকোন উচ্চতর কোর্টের রায় ও সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে রেফারেন্স হিসাবে বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত। খুব অবাক ও দুঃখ লাগছে বার, বেঞ্চ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিক কারও মনে পড়ল না অতীব গুরুত্বপূর্ণ অত্যন্ত প্রয়োগ যোগ্য এই রেফারেন্সটির কথা। খাপে খাপে মিলে যাওয়া। আমরা কি কোভিড অতিমারীর সাথে সাথে যুগপৎ মেধাপ্রতিবন্ধীত্বের মহামারীর শিকার হচ্ছি? রোজিনা ইসলাম, অনুরোধ আপনি অন্তত পেন্টাগনের দলিল ফাঁসের সবকিছুকে সবার সামনে নিয়ে আসবেন আর উন্নত শিরে ডেনিয়েল এলসবার্গের বলতে পারবেন, ‘আমি যা করেছি তা তথ্য লোপাটকারী দুর্নীতিবাজ আমলাদের কাহিনী দেশের মালিকদের জানিয়েছি। এটা কখনও চুরি হতে পারে না। আমি চোর নই, আমি দেশের মালিকদের কল্যাণের স্বার্থের পাহরাদার’।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।