পৃথিবী-বিখ্যাত সিল্ক রুট

রিয়াজুল হক | বুধবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

তোমরা ভাবোতো আজ থেকে প্রায় ১,৮০০ বছর পূর্বে উটের পিঠে চাপিয়ে সিল্ক এবং অন্যান্য সামগ্রী চীন থেকে ইউরোপে যাচ্ছে। বণিকেরা রশি ধরে উটগুলোকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো সিল্ক রুটের কথাই বলব আজকে।

তোমাদের কেউ কেউ হয়তো সিল্ক রুট সম্পর্কে জেনে থাকবে। এটি ছিল বাণিজ্য রুটের আন্তর্জাতিক একটি নেটওয়ার্ক। একটি প্রাচীন বাণিজ্য পথ যা পশ্চিমা বিশ্বকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সাথে সংযুক্ত করেছিল। এটি রোমান সাম্রাজ্য ও চীন এবং পরবর্তীতে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাম্রাজ্য ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের একটি প্রধান মাধ্যম ছিল। কোথা থেকে শুরু হয়েছিল এই রুটটি জানো? এই রুটের শুরু ছিল উত্তরমধ্য চীনের শিয়ানে (আধুনিক শানসি প্রদেশে)। বাণিজ্য কাফেলা চীনের গোবি মরুভূমি এবং চীনের মহাপ্রাচীর বরাবর গিয়ে পামির মালভূমি পেরিয়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ইরান এবং তুরস্ক অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে পৌঁছতো। এরপর ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে পণ্য পাঠানো হতো ইউরোপে।

রুটটি কত কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল জানো? এশিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ৬,৪০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃৃত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি সক্রিয় ছিল। এই পথ দিয়ে শুধু যে সিল্ক বাণিজ্য হতো তা কিন্তু নয়। ইউরোপের সাথে এশিয়ার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যমও ছিল এটি। তখন সিল্ক উৎপন্ন হতো শুধু চীনে। এই সিল্ক উটের পিঠে চাপিয়ে ইউরোপে পাঠানো হতো এই পথ ধরে। তাই এই রুটটির নাম সিল্ক রুট। সিল্ক ছাড়াও বণিকেরা মূল্যবান পাথর, চীনামাটির বাসন, চা এবং মশলা নিয়ে যেত ইউরোপে। বিনিময়ে ইউরোপ থেকে উল, স্বর্ণ, রূপা, কাচের জিনিসপত্র এবং ঘোড়া নিয়ে আসতো।

তোমরা বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলোর নাম হয়তো শুনেছো। ইতালির ভেনিসের ধনী বণিকদের একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার সাথে এই পথ ধরে চীন ভ্রমণ করেছিলেন। তিন বছরেরও অধিক সময় এই রুট ধরে ভ্রমণ করে ১২৭৫ খ্র্রিস্টাব্দে তাঁরা কুবলাই খানের প্রাসাদে পৌঁছান। মার্কোরা খানের দরবারে অবস্থান করেছিলেন কিছুদিন। এর আগে কোনো ইউরোপীয় এই পথে ভ্রমণ করেননি। ফিরে আসার পর মার্কো পোলো তার দুঃসাহসিক অভিযান সম্পর্কে লিখেছিলেন যা তাকে এবং তিনি যে পথে ভ্রমণ করেছিলেন সেটিকে বিখ্যাত করে তুলেছিল।

বস্তুগত পণ্য ছাড়াও সিল্ক রুট বরাবর পশ্চিমের অন্যতম প্রধান রপ্তানি ছিল ধর্ম। প্রথম দিককার অ্যাসিরিয়ান খ্রিস্টানরা(সিরিয়ার খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী) তাদের বিশ্বাসকে মধ্য এশিয়া এবং চীনে নিয়ে গিয়েছিল এই পথ ধরেই। আর ভারতীয় উপমহাদেশের বণিকরা চীনকে বৌদ্ধ ধর্মের কাছে উন্মুক্ত করেছিলো। রোগও কিন্তু ছড়িয়েছিলো এই পথ ধরেই। অনেকে বিশ্বাস করেন যে বিউবনিক প্লেগ এশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে কারণে ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্ল্যাক ডেথ মহামারী দেখা দেয়।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো সরকার না থাকায় রাস্তাগুলো সাধারণত খারাপ অবস্থায়ই ছিল। ডাকাতদের আক্রমণও ছিল সাধারণ ঘটনা। তাই নিজেদের রক্ষা করার জন্য বণিকরা উট বা অন্যান্য ভারবাহী পশু নিয়ে কাফেলায় শরিক হতো। সময়ের সাথে সাথে বণিকদের বিশ্রামাগার বা সরাইখানা তৈরি হয় এই যাত্রা পথে। তবে অল্প কিছু লোকই পুরো রুটে ভ্রমণ করতো। ফলে পথের ধারে অনেক মধ্যস্বত্বভোগী এবং কেনাবেচার বাজার তৈরি হয়েছিলো এই পথ জুড়ে।

বর্তমানে সিল্ক রুটের কিছু অংশ পাকিস্তান এবং চীনের জিনজিয়াংয়ের উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সাথে সংযোগকারী একটি পাকা মহাসড়কের আকারে টিকে আছে। ২১ শতকে জাতিসংঘ একটি ট্রান্সএশিয়ান মোটর হাইওয়ে এবং রেলপথ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করে। বর্তমানে চীন ’বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’এর মাধ্যমে একটি বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে সিল্ক রুটটি পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তাই সিল্ক রুটের অংশগুলো এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশে আছে রুটটির একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর উজবেকিস্তানের সমরখন্দ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেঘ দিদি
পরবর্তী নিবন্ধসাবেক মেয়র মনজুর আলমের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়