বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে রচিত হলো নতুন এক অধ্যায়। চট্টগ্রামের সন্তান ডা. বাবর আলী পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মানাসলু (৮,১৬৩ মিটার/২৬,৭৮১ ফুট) জয় করেছেন কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই। গতকাল (শুক্রবার) ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে তিনি এই শিখরে পৌঁছান। এটাই প্রথমবার কোনো বাংলাদেশি অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শৃঙ্গ জয় করলেন। বাবরের সাথে ছিলেন দীর্ঘদিনের পর্বতসঙ্গী বীরে তামাং।
একই অভিযানে বাংলাদেশের আরেক পর্বতারোহী তানভীর আহমেদও প্রথমবারের মতো সফলভাবে জয় করেছেন আটহাজারি শৃঙ্গ। এই অভিযানে তাঁরা অংশ নেন ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর ব্যানারে, যার সভাপতি ও অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান। অভিযানটির শিরোনাম ছিল ‘মানাসলু অ্যাসেন্ট : ভার্টিক্যাল ডুয়ো’। আউটফিটার হিসেবে সহায়তা দিয়েছে নেপালের সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান স্নোয়ি হরাইজন ট্রেক্স এন্ড এক্সপিডিশন।
৮ হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আছে পৃথিবীতে চৌদ্দটি। ওই উচ্চতায় অক্সিজেন থাকে ভূ–পৃষ্ঠের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। ফলে মানবদেহ সচল রাখতে পর্বতারোহীরা ব্যবহার করেন কৃত্রিম অক্সিজেন। আর বাংলাদেশের স্বনামধন্য পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী আজ ইতিহাস গড়লেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আটহাজারি শিখর আরোহণ করে।
ডা. বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া ৮ হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতার এ পর্বত জয় করলেন। এর আগে তিনি এভারেস্ট, লোৎসে এবং অন্নপূর্ণা–১ জয় করে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছেন। বাবরের এই সফলতা দেশের পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক বিরল অর্জন।
এই অভিযানে নতুন দৃষ্টান্ত গড়েছেন কিশোরগঞ্জের সন্তান তানভীর আহমেদও। তিনি দেশের ভেতর সীমিত সুযোগ–সুবিধার মধ্যেই অনুশীলন করে প্রস্তুতি নেন। বিদেশে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স না করেও প্রথম আটহাজারি শৃঙ্গে সফল হন তিনি। ফরহান জামান জানান, ‘দীর্ঘদিনের ধারণা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া এ ধরনের উচ্চতর অভিযানে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তানভীর আজ সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছেন।
‘মানাসলু’ পশ্চিম–মধ্য নেপালের নেপালি হিমালয়ের অংশ মানসিরি হিমালে অবস্থিত। উচ্চতায় ৮ম হলেও বিশ্বের প্রাণঘাতী পর্বতগুলোর মধ্যে এর অবস্থান চতুর্থ।
পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সভাপতি ও অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, অভিযানের সূচনা হয় গত ৫ সেপ্টেম্বর। ওইদিন বাংলাদেশ থেকে নেপালে পৌঁছান বাবর ও তানভীর। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে তিলচে গ্রামে যান এবং পাঁচদিন হেঁটে পৌঁছান বেসক্যাম্পে।
পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া শেষ করে তারা ধাপে ধাপে ক্যাম্প–১, ক্যাম্প–২, ক্যাম্প–৩ হয়ে ক্যাম্প–৪ এ (৭৪০০ মিটার) পৌঁছান। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে শীর্ষ অভিযানে যাত্রা শুরু করে ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে তাঁরা স্পর্শ করেন মানাসলুর চূড়া।
বাবরের লক্ষ্য বিশ্বের ১৪টি আটহাজারি শৃঙ্গ জয় করা। এ পর্যন্ত তিনি চারটি জয় করেছেন। অপরদিকে তানভীর ভবিষ্যতে আরও অনেক শৃঙ্গ জয় করতে চান। দুজনেই বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে ২০২৪ সালের ১৯ মে বাবর আলী ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। তার আগে মুসা ইব্রাহীম, আবদুল মুহিত, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন এবং খালেদ হোসেন এভারেস্ট জয় করেছিলেন (যার মধ্যে খালেদ হোসেন ফেরার পথে প্রাণ হারান)। তবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া ৮ হাজারি জয় এবারই প্রথম।
ফরহান জামান বলেন, ‘বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে একই দিনে দুইবার উড়ল আমাদের লাল–সবুজের পতাকা। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শিখর আরোহণের। উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর আমরা চূড়ান্তভাবে ঠিক করি যে এই মানাসলুই হবে কাক্সিক্ষত সেই চেষ্টার পর্বত। আজ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাবর আলী কৃত্রিম অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই আরোহণ করেছেন এই শৃঙ্গে।
ফরহান জামান জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র ডা. বাবর আলী হাটহাজারীর নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগমের সন্তান। বর্তমানে তিনি ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর সাধারণ সম্পাদক।
তানভীর আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশে কর্মরত এবং এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পৈতৃক নিবাস কিশোরগঞ্জ সদরের খরমপট্টি। বাংলাদেশের পতাকা বহন করে ডা. বাবর আলী ও তানভীর আহমেদের এই জয় নিঃসন্দেহে দেশের পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন অনুপ্রেরণা যোগাবে বলেও মন্তব্য করেন ফরহান জামান।