এক .
শীতের সকাল। মির্জা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। খুব ভোরে ওর ঘুম ছুটে গেছে। দূরে কোথাও দেশাত্মবোধক গান বাজছে। সে আকুল হয়ে সে সুররে মায়াজালে ডুবে গেছে। আজ ১৬ই ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। এই দিনেই পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিল। এতেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। একটি স্বাধীন লাল–সবুজের পতাকা পেয়েছিল। একটি জাতীয় সংগীত পেয়েছিল। একজন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি পেয়েছিল।
দুই.
মির্জা বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে প্রস্তুত হয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে শহীদ মিনারে গেল। শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর খুব মন খারাপ করে বন্দর কবরস্থানের দিকে যাত্রা করলো। ওর বাবাসহ সকল কবরবাসীর জন্য দোয়া করলো। কবর জিয়ারত করলো। এরপর চলে গেল খাল পাড়ে কবরস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানে অনেক ঝোপঝাড়। মির্জা ঝোপঝাড়ের ভিতরে ঢুকে পড়লো। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। ওর বাবা মুখ থেকে শোনা, সেই বড় গোল পাথর টা দেখল। পাথরটাকে সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে চমকে উঠলো। কেমন যেন এক রকম শিহরণ ওর সমস্ত শরীরে বয়ে গেল। তারপর সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সে পাথরটাকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখের জলে সিক্ত হয়ে ভাবল, আহা বেচু চাচা। আমার বেচু চাচার প্রাণটা এখান থেকেই উড়ে গেছে। এরকম আরো কত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রাণের শেষ নিঃশ্বাসের ছোঁয়া এই পাথরের গায়ে লেগে আছে। ঐ প্রাণগুলো কি আজ এখানে এসেছে নাকি? বেচু চাচাও কি এসেছে? বেচু চাচা চেয়ে দেখো, আমি আজ কত বড় হয়েছি। আমি এখন একটা সরকারি চাকরি করি। আমার স্ত্রী আছে। তিনটা সন্তান আছে। আমার মা আছে। মা তোমার গল্প করে। তবে মা খুব অসুস্থ। বাবা আজ আর বেঁচে নেই। তবে বাবা–মা, তুমি এবং আমার একসাথে তোলা সেই সাদা কালো ছবিটা এখনো আছে। বেচু চাচা, তোমার সাথে বাবার কি দেখা হয়? জানো, বাবা তোমাকে খুব ভালবাসত। তখনকার কথা আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমিতো তখন খুব ছোট ছিলাম। এখন আমি অনেক বড় হয়েছি। আমার চুল পেকেছে। দাড়ি গোঁফ পেকেছে। আমার বয়স এখন পঞ্চাশের উপরে।
তিন.
মির্জা বাবার মুখে শুনেছে, এই কবরস্থানে মুক্তিযুদ্ধের একটা বধ্যভূমি আছে। এখনো কেউ তা আবিষ্কার করেনি। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে বিহারীরা এই বড় গোল পাথরটা উপর মাথা রেখে ভারী তলোয়ার দিয়ে এক কোপে মাথা কেটে ফেলতো। মাথাটা পড়ে থাকতো। আর মাথাবিহীন শরীর খালের স্রোতে ভাসিয়ে দিতো। সে শরীর ভেসে ভেসে কর্ণফুলী নদীতে যেত। সেখান থেকে বঙ্গোপসাগরে যেত। বেচু চাচাকেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় যুদ্ধের ক্যাম্প থেকে ধরে এনে এখানে এই পাথরে ওপর মাথা রেখে এক কোপে দ্বিখন্ডিত করে শহীদ করেছিল। মাথাবিহীন দেহটা খালের জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। মাথাটা এখানে হয়তো কোথাও মাটি চাপায় পড়ে আছে।
এই ঘটনা জানার পর মির্জার বাবা মা আর কোনদিন সাগর নদী খালের কোন মাছ বা পানি খায়নি। এসব স্থানে কোনদিন বেড়াতেও যায়নি। ওখানে গেলে শুধু বেচু চাচার দ্বিখন্ডিত দেহ আর রক্ত দেখতে পায়। মির্জাও এর আগে আর কোনদিন এই কবরস্থানের এখানে আসেনি। আজ এসেছে। সে আজ এখানে কিছু একটা খুঁজছে। আর ওই গোল বড় পাথরটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বারবার চোখের জল ফেলছে।
চার .
মির্জা চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরতেই হঠাৎ ঘাসের ভিতর বালির ফাঁকে ধবধবে সাদা কিছু একটা দেখতে পেল। সে তার সমস্ত ব্যাঘ্রতা নিয়ে ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাটি খুঁড়ে ওই সাদা বস্তুটা বের করে আনলো। সেটাকে পরিষ্কার করে ভালোভাবে দেখলো, ওটা একটা মানুষের মাথার খুলি। নিশ্চয়ই কোন মুক্তিযোদ্ধার মাথার খুলি। যাদেরকে বিহারীরা ধরে এনে এখানে পাথরের রেখে দ্বিখন্ডিত করেছিল। এটা কার মাথার খুলি? কার হতে পারে? এটা মির্জার কাছে আসলো কেন? এই রকম হাজার হাজার প্রশ্ন ওকে প্রায় পাগল করে তুললো।
মির্জা খুলিটা এনে খুবই সম্মানের সাথে ওর লেখার টেবিলের উপর রাখল। পরিবারের সবাইকে সব ঘটনা খুলে বলল। ওর স্ত্রী সন্তানরা ভয়ে কেউ কাছে আসলো না। ভয় ওরা কেউ ওই রুমে যাচ্ছেও না। তিনদিন পর মির্জা একটা লাল সবুজের জাতীয় পতাকা কিনে আনলো। ওটার মধ্যে মাথার খুলিটা জড়িয়ে মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেল। ডিএনএ টেস্টের জন্য ওর নিজের স্যাম্পল দিল। ডিএনএ রিপোর্ট আসলো। রিপোর্ট সেম্পলের সাথে ম্যাচ করল। মির্জার স্যাম্পল এর সাথে ওই মাথার খুলির ডিএনএ’র রেজাল্ট রিপোর্টটা হুবহু মিলে গেল। মানে এই মাথার খুলির মানুষটা ওদের বংশধর। কে? কে হতে পারে? হয়তো এটাই মির্জার মুক্তিযোদ্ধা বেচু চাচার মাথার খুলি হবে! সে লাল সবুজ পতাকা জড়ানো মাথার খুলিটাকে টেবিলের উপর রেখে অতি সসম্মানে স্যালুট করলো। তারপর জাতীয় পতাকা মোড়ানো খুলিটা নিয়ে মির্জা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো।
বুকের মধ্যে জড়ানো লাল সবুজ পতাকা মোড়ানো মুক্তিযোদ্ধা বেচু চাচার মাথার খুলি। হঠাৎ মির্জার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কান্নার স্রোত। সে চিৎকার করে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। কোনভাবেই থামছে সে কান্না।
ওর আশেপাশে অনেক লোক জমে গেল। সবাই ওকে অবাক হয়ে দেখছে। দূরে কোথাও গান বেজে চলছে, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল।’









