বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার ঘটনার রহস্য এখনো উদ্ধার হয়নি। এই ঘটনায় পুলিশ তিনটি ক্লু নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঘটনার ব্যাপারে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সব বিবেচনা করে মামলার তদন্ত চলছে। আশা করা যায়, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে ঘটনার মূল রহস্য বের হয়ে আসবে।
গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর মোহনা সংলগ্ন নাজিরারটেক পয়েন্টে ডুবে যাওয়া একটি ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়। ট্রলারটির মালিক মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ারছড়া এলাকার ছনখোলা পাড়ার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝি। তার মরদেহ গ্রহণ করেছেন তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। এ ঘটনায় মামলার বাদীও তিনি।
গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনার রহস্য বের করতে পুলিশের ৫টি দল কাজ করছে। ইতোমধ্যে নিহত নুরুল কবির ও সামশু মাঝির বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও হত্যা মামলা পাওয়া গেছে। সব বিবেচনায় তদন্ত চলছে। নিহতদের মধ্যে এমন কয়েকজন পাওয়া গেছে যারা জীবনে কখনো সাগরে যাননি বলে স্বজনরা দাবি করছেন। নিহত নুরুল কবির এদের ডেকে সাগরে নিয়ে যায়। এর বাইরে এ ঘটনায় মাদক সংক্রান্ত একটি বিষয়টিও সামনে এসেছে। এটাও তদন্তে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, মামলার স্বার্থে নিহতদের স্বজন, ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
লাশ উদ্ধারের বিবরণ দিয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ জনের লাশ ট্রলারের বরফ রাখার কক্ষ থেকে অর্ধগলিত উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের হাত–পা রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। কয়েকজনের শরীরে জাল পেঁচানো ছিল। একটি লাশের গলা থেকে মাথা ছিল বিচ্ছিন্ন। আরেকটি লাশের হাত বিচ্ছিন্ন ছিল। ট্রলারের যে কক্ষ থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয় সেই কক্ষের ঢাকনা পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে সন্দেহ হয়, পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে পর ট্রলারটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
জেলেদের মতে, এই ট্রলারের কেউই পেশাদার জেলে ছিলেন না। তারা ছিলেন মূলত ডাকাত। তারা সোনাদিয়ার পশ্চিমে একটি ট্রলার ডাকাতির পর ক্ষিপ্ত জেলেরা আশেপাশের ট্রলারের জেলেদের সংগঠিত করে শামসু মাঝির বোটের উপর হামলা চালায়। এতেই মারা যায় ১০ জেলে।
জলদস্যুদের দুটি বোট ছিল এবং তার মধ্যে একটি বোটের জলদস্যুরা হামলার শিকার হয়েছে। অপর ট্রলারের জলদস্যুরা হামলা থেকে বেঁেচ গিয়ে এলাকায় ফিরে ঘটনাটি প্রকাশ করে দেয়।
কক্সবাজার জেলার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন জানান, উদ্ধার হওয়া ট্রলারটির গায়ে কোনো নাম ছিল না। ট্রলারটি তাদের সমিতির অন্তর্ভুক্তও নয়। এছাড়া যারা মারা গেছে তারা প্রকৃত জেলে কিনা তা নিয়েও সাধারণ জেলেদের সন্দেহ রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, জলদস্যুতার সাথে জড়িত ট্রলার ও ডাকাতরা এমনই হয়। নিহত স্বজনদের বক্তব্য থেকেও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা আসলে পেশাদার জেলে ছিলেন না।
নিহত মহেশখালীর শাপলাপুরের ওসমান গনির মা জহুরা বেগম সোমবার ছেলের লাশ শনাক্ত করতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তার ছেলে ওসমান জীবনে কোনো দিন ট্রলার নিয়ে সাগরে যায়নি। সে কক্সবাজার শহরে একটি দোকানে চাকরি করত। পরে মহেশখালীতে গিয়ে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ৭ এপ্রিল স্থানীয় নুরুল কবির নামের এক ব্যক্তি ওসমানকে ট্রলারে তুলে সাগরে নিয়ে যায়। কিন্তু কেন নিয়ে গেল বুঝে আসছে না। তিনি মনে করেন, তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মর্গে লাশ নিতে এসে চকরিয়ার কোনাখালীর তারেক জিয়ার বাবা জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, তার ছেলে এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করত। কিন্তু কেন সে ট্রলারে করে সাগরে গেল তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি জানান, তার ছেলে এক বন্ধুর কথায় স্টেশনে যাচ্ছে বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। রোববার খবর পেয়ে নাজিরারটেক উপকূলে লাশের সারিতে ছেলেকে শনাক্ত করেন।
পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১১ এপ্রিল সাগর থেকে ফিরে আসা ৬ জেলে নিহতের স্বজনদের তথ্য দিয়েছিলেন যে, ডাকাতি করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে হিমঘরে বন্দী হয়ে তারা মারা গেছে। ৬ জনের তথ্যমতে প্রচার ছিল, সামশু মাঝির ট্রলারে করে ৭ এপ্রিল সাগরে যান ১৯ মাঝিমাল্লা। ৯ এপ্রিল গভীর সাগরে ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি করার অভিযোগে ৪/৫টি ফিশিং ট্রলার সামশু মাঝির ট্রলারকে ধাওয়া করে আটক করে এবং ট্রলারটির সবাইকে হাত–পা বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়।












