পুলিশভ্যানে ট্রেনের ধাক্কা, তিন কনস্টেবল নিহত

এসআই ও ইউপি সদস্যের অবস্থা সংকটাপন্ন গেটম্যান বরখাস্ত, দুই তদন্ত কমিটি

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি | সোমবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ডে থানার পুলিশ পিকআপ ভ্যানে ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুজন পুলিশ সদস্যসহ তিনজন। আহতরা বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১২টায় উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের ফকিরহাট সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন, বাগেরহাট জেলার চিতলমারি থানার ভাড়াশিয়া এলাকার মসরুম মোল্লার ছেলে এস্কান্দার আলী মোল্লা (৪৩), গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর থানার উজানী এলাকার ইমান আলী মুন্সির ছেলে মিজানুর রহমান (৪৪) ও কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মৌলভী বাজার এলাকার মো. ফরিদ আহম্মদের ছেলে মো. হোসাইন (৩৮)। নিহত পুলিশ সদস্য এস্কান্দার ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর সীতাকুণ্ড থানায় যোগদান করেন। এছাড়াও নিহত মিজানুর চলতি বছরের ২৪ মার্চ ও হোসাইন ২০২০ সালের ১৯ জুলাই সীতাকুণ্ড থানায় যোগদান করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আহত হয়েছেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুজন শর্মা ও পুলিশ সদস্য চালক সমর চন্দ্র সূত্রধর এবং সলিমপুর ইউপি সদস্য মো. শাহাদাত হোসেন। আহতদের মধ্যে এসআই সুজন শর্মা ও ইউপি সদস্য শাহাদাত হোসেনের অবস্থা সংকটাপন্ন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার হাসান চৌধুরী, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির আহমেদ, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম, সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি তোফায়েল আহমেদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুরে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশবাহী পিকআপ ভ্যানটি ফকিরহাট রেলক্রসিং এলাকা অতিক্রমের সময় চট্টগ্রামমুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশবাহী পিকআপ ভ্যানটি দুমড়েমুচড়ে যায়। দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংয়ে কর্তব্যরত গেটম্যান দিপু সেখানে ছিলেন না। যার কারণে সিগনাল বাঁশ ওঠানো ছিল। এ সময় ঘটনাস্থলেই পুলিশ সদস্য এস্কান্দরের মৃত্যু হয়। শরীর থেকে হাত, পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গুরুতর আহত হন সীতাকুণ্ড থানার আরও পাঁচ পুলিশ সদস্য। পরে স্থানীয়রা আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর চিকিৎসক আহত পুলিশ সদস্য মিজান ও হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন।

সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ জানান, টহল ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের বহনকারী গাড়িটি রেললাইন পারাপারের সময় চট্টগ্রামমুখী সোনার বাংলা আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে এক পুলিশ সদস্যের এবং চমেক হাসপাতালে আরও দুই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। এছাড়া দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত আরও দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের অবস্থাও সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি আরো জানান, দুর্ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের তিনটি অস্ত্র (শর্টগান) ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১৬ রাউন্ড শর্টগানের গুলি পাওয়া গেলেও উপপরিদর্শক (এসআই) সুজন শর্মার নামে ইস্যু করা পিস্তলের গুলি গুলো পাওয়া যায়নি।

ঘটনাস্থলে থাকা ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক সামিউর রহমান বলেন, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের একটি টহল দল স্থানীয় এক ইউপি সদস্যসহ আসামি ধরতে যাচ্ছিল। তাদের গাড়িটি রেললাইনের পশ্চিম থেকে পূর্ব পাশে পার হওয়ার সময় আটকে যায়। এ সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী সোনার বাংলা ট্রেনটি গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই এক কনস্টেবল নিহত হন।

গেটম্যান বরখাস্ত, দুই তদন্ত কমিটি গঠন : রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় গেটম্যানের গাফিলতির প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় গেটম্যান শাহরিয়ার মাহমুদ দীপুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিস্তারিত জানতে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেনবিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) আনিসুর রহমান, বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) সাজিদ হাসান ও বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিএন) রফিকুল ইসলাম এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যাট রেজাউনুর রহমান। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এএসপি (সীতাকুণ্ড সার্কেল), চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) প্রতিনিধি। দুই কমিটিই সাতদিনের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট দেবেন।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রেলক্রসিংয়ে একজন গেটম্যান সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, তিনি সেখানে ছিলেন না। বারও ফেলা হয়নি। সার্বিক তদন্তের জন্য আমরা চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. আবিদুর রহমান বলেন, গেটম্যান যে সবসময়ই থাকে না, সেটা মানতে পারছি না। তবে আজ সে অনুপস্থিত ছিল বলে আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি। এজন্য তাকে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সবাই আমাকে জানিয়েছেন, ওই গেটম্যান কখনোই সেখানে থাকতেন না। লোহার বার সবসময় তোলা থাকত। যদি গেটম্যান তার দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। তার গাফিলতির কারণেই আজ দুর্ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন।

সীতাকুণ্ড থানায় শোকের ছায়া : তিন সহকর্মীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সীতাকুণ্ড মডেল থানায়। থানা পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত মো. সালাউদ্দিন জানান, দুর্ঘটনায় নিহত হোসাইনের সঙ্গে একই ব্যারাকে পাশাপাশি বিছানায় থাকতেন। হোসাইন মারা গেছেন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কান্নারত অবস্থায় বলেন, হাসানের মুখে সবসময় হাসি থাকত। কিছুদিন আগে কঙবাজারে তার বাবা মারা যায়। বাবাকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠে বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন তিনি।

থানার আরেক কনস্টেবল জামিল বলেন, নিহত তিনজনের সাথে কত খুনসুঁটি করেছি। এভাবে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না।

নিহত এসকান্দার আলীর বাসার মালিক জেসমিন আক্তার বলেন, এস্কান্দার সাহেব আমাদের ২য় তলায় থাকেন। আমরা একই পরিবারের সদস্যের মতো। কি ভাবে তার পরিবারকে শান্তনা দিবো ভাষা নেই। ভাবীর কান্নায় পুরো মেডিকেল অস্থির। আল্লাহ যেন এমন মৃত্যু কাউকে না দেন।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সকালে পুলিশ সদস্যদের টহল ডিউটিতে পাঠিয়েছি; দুপুরে দুর্ঘটনা ঘটলো। এ মৃত্যু কোনো ভাবে মেনে নিতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, নিহত তিনজনই কোনোদিন দায়িত্বে অবহেলা করেননি। রাতে ডিউটি করার পর সকালে আবার ডিউটিতে বেরিয়ে যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন সপ্তাহের মধ্যে আবার ডুবল নগরী
পরবর্তী নিবন্ধনালায় পড়ে নিখোঁজ দেড় বছরের শিশু