পুরুষের একাধিক বিয়ে ও আইন

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ২৫ মে, ২০২৪ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজিতে একটা কথা আছে Nature abhors vacuum অর্থাৎ প্রকৃতিতে শূন্যতার কোনো স্থান নেই। স্বামীস্ত্রীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কখনো কখনো এই রকম ছোট ছোট শূন্যতা তৈরি হয়। এইসব শূন্যতার ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক দুর্বল মুহূর্তে স্বামী জড়িয়ে যেতে পারেন অন্য কোনো সম্পর্কে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষটি নিজের ঘর ভাঙ্গার কথা ভাবেন না। কিছুদিন পরেই মোহ কেটে যায় এবং তিনি ফিরে আসতে চান। হয়তো লজ্জা এবং দাম্পত্যের তিক্ততার কারণে তিনি ইতস্তত করেন। কিন্তু সমাজের নানাবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন সত্ত্বেও পুরুষের বহুবিবাহপ্রথা এখনো চলমান। তার নানা কারণ রয়েছে যদিও।

সময়ের পরিক্রমায় মানুষ আদিমতার গণ্ডি পেরিয়ে যখন সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করল, তখন কামনার সঙ্গে সমৃদ্ধ হতে থাকে ভালোবাসা নামক বোধটি। নারীপুরুষ চিন্তার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধে ঋদ্ধ হতে থাকে ঠিকই, সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের অন্তর্গত জটিলতাও। ব্যস্ত মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ ও অতৃপ্ত। একঘেয়েমি কাটাতে স্বস্তি খোঁজে নতুন কারো কাছে। কিন্তু পুরুষের বহুগামিতার ব্যাপারে আইনকানুন শিথিল হলেও নারী বহুগামিতাকে সব সময়ই অধিকতর নিন্দনীয়ভাবে দেখা হয়; বহুগামী স্ত্রীকে শারীরিক নিগ্রহ, এমনকি হত্যা করা হলেও সমাজে খারাপ চোখে দেখা হয় না।

দাম্পত্য সম্পর্কে নানা কারণে তিক্ততা আসে, একঘেয়ে হয়ে উঠে জীবন। জীবনের রং বদলাতে নতুন জানালার খোঁজ করে মানুষ। শ্বাস নিতে চায়। একপক্ষ যখন অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন তা অন্য পক্ষের জন্য হয় তীব্র যন্ত্রণার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের সম্পর্কের ভীত হয় সাময়িক আকর্ষণ এবং বিবাহিত জীবন একঘেয়ে হয়ে যাওয়ার জন্য। আধুনিক নরনারীর দাম্পত্য জীবনের বহুমাত্রিক সংকট, অন্তর্গত জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা, দাম্পত্য বিষয়ে সামাজিক দায়িত্বভার, নারী ও পুরুষের অতৃপ্তিবোধ তাড়া করে অন্য কারো মাঝে স্বস্তি বা শান্তি খুঁজে পেতে। অনেক সময় সে লুকোচুরির সম্পর্ক গড়ায় বিয়ে অবধি।

কিন্তু সেই বিয়ে কি স্বস্তিদায়ক? আইন কী বলে! পুরুষ জীবনের একঘেয়েমি ছাড়তে প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়তৃতীয় বিয়ের আশ্রয় নিলেও, নারীর ক্ষেত্রে সেটা আদৌ সমাজ মেনে নিতে প্রস্তুত? কোনো নারী নিশ্চয়ই চায় না, স্বামীর অপর স্ত্রীর সাথে সংসারস্বামী ভাগাভাগি করতে। কিন্তু এই বাস্তবতায়ও আমাদের সমাজে খোঁজ নিলে কোথাও না কোথাও স্বামীর স্ত্রীরা একই ঘরে, একই স্বামীর সাথে সংসার করতে দেখা যায়। ইসলাম ধর্মে পুরুষের “চার বিয়ে জায়েজ” এই দোহাই দিয়ে বহুবিবাহকে সহজ শর্তে হালাল করা হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কতটা সহজ? ইসলাম বলেছেএকের অধিক স্ত্রীকে সমান দৃষ্টিতে, সমান অধিকারে রাখা একজন মানুষের পক্ষে কতটা সম্ভব। যেখানে মানুষ মাত্রই পক্ষপাতদুষ্ট।

প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ সালের ৬ ধারা মতে, কোনো পুরুষ যদি একটি বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করতে চান তাহলে ‘সালিস পরিষদ’এর অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এ রকম পূর্ব অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করলে সেই বিয়ে নিবন্ধিত হবে না।

আইনটির ৬ ()- এ বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতির জন্য নির্দিষ্ট ফিসহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনপত্রে বিয়ের কারণ এবং বর্তমান স্ত্রীর সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না তা উল্লেখ করতে হবে।

যদি সালিস পরিষদ মনে করে, প্রস্তাবিত বিয়েটি প্রয়োজনীয় এবং ন্যায়সঙ্গত, কেবল তখনই বহু বিয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।

সালিস পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে তা হবে একটি অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে ১ বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া দেনমোহরের যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর পরিশোধ না করলে বকেয়া রাজস্বের মতো আদায় হবে। যদিও দেনমোহরের সাথে বিয়ের সম্পর্ক। তা দ্বিতীয় বিয়ে বা তালাকের সাথে সম্পর্কিত নয়।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৪ ধারা মতে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে এই ধারার বিধানমতে স্ত্রী ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। এ সময় স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কাবিননামা আদালতে দেখাতে হবে। স্বামীর অপরাধ প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।

যেসব কারণে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন

মুসলিম পারিবারিক আইন বিধিমালা ১৯৬১ এর ১৪ বিধি মতে, বেশ কিছু কারণে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন। যেমন: স্ত্রী যদি বন্ধ্যা হন, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকেন, দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য শারীরিকভাবে অসমর্থ, দাম্পত্য অধিকার পুনঃস্থাপনের জন্য কোনো ডিক্রিকে ইচ্ছাকৃত পরিহার, স্ত্রীর বাতুলতা বা উন্মত্ততা (মানসিক বিকার) ইত্যাদি।

স্বামী থাকা অবস্থায় কি নারী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন?

মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রথম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন না। যদি দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে হবে আইনত অপরাধ।

প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় যদি স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করেন, তাহলে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মামলা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড পেতে পারেন এবং সেই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে।

তবে প্রথম স্বামী সাত বছর যাবৎ সেই স্ত্রীর যদি কোনো খোঁজখবর না নেন, অথবা (নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশ) স্বামী জীবিত থাকতে পারেনএমন কোনো তথ্য যদি জানা না যায়, তাহলে হবু স্বামীকে সত্যি ঘটনা জানিয়ে সেই স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন। এটি দন্ডবিধির ৪৯৪ ধারার বিধানের ব্যতিক্রম। আর এই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য হবে না।

অন্যদিকে স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় যাকে বিয়ে করছেন, তাঁর কাছে আগের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলে সেটি হবে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং জরিমানা।

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধতক্ষকসহ আটক ২
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সমাধিতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের শ্রদ্ধাঞ্জলি