‘আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে, বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোন উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে’।
কথাটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। আর এই একটি বাক্যের মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ পুরুষতন্ত্রের সামগ্রিক অসহনীয় এক চিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন।
বছরটি ১৩২১ বঙ্গাব্দ। কবি শ্রাবণ মাসে লিখলেন তাঁর বহুল পঠিত বিখ্যাত ছোটগল্প ‘স্ত্রীর পত্র’। তার দু’মাস আগে জ্যৈষ্ঠে লিখেছিলেন আরেক অনবদ্য গল্প ‘হৈমন্তী’। আর এরও তিনমাস পর কার্তিকে লিখলেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অব্যর্থ প্রতিবাদ অপরিচিতা’ ছোটগল্পটি।
গল্প তিনটার লেখার ক্রম অনুসারে পাঠ না করে আমরা যদি প্রথমেই ‘স্ত্রীর পত্র’ দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ‘হৈমন্তী’ এবং সবশেষে ‘অপরিচিতা’ পড়ি তবে খুবই আশ্চর্যজনকভাবে অন্য আর একটা গল্পের সূত্র খুঁজে পাবো আমরা। আর সেই অলিখিত গল্পের মধ্য দিয়ে কবি আমাদের চোখের সামনে এই বক্তব্যটাই তুলে ধরলেন যে, এই পুরুষতন্ত্র কিভাবে ব্যক্তিপুরুষের শৃংখলিত অমেরুদণ্ডী সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে।
কবিগুরুর ছোটগল্প সম্ভারের মধ্য থেকে ‘স্ত্রীর পত্র’’ ‘হৈমন্তী’ ও ‘অপরাচিতা’ – এই তিনটা ছোটগল্প ( বিষয়বস্তু নয়) আজকের আলোচ্য বিষয় হলেও গল্পের তিন প্রধান নারীচরিত্র, যথাক্রমে মৃণাল, হৈমন্তী ও কল্যাণী, যাদেরকে বলা যায় নারীমুক্তি আন্দোলনের তিন চাপা কণ্ঠস্বর, তারা কিন্তু আজকের আলোচ্য নয়। বরঞ্চ তাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা তিনজন মেরুদণ্ডহীন পুরুষকে নিয়েই আমার আজকের আলোচনা।
আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুও নারীচরিত্রগুলো নিয়ে নয়। চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রথমেই আসি ‘স্ত্রীর পত্র’ এর মুখ্যচরিত্র মৃণালের পতিদেবতাটির বেলায়, যে কিনা পুরুষতন্ত্রেরএক অন্যতম উৎপাদনস্বরূপ। মৃণালের মত রত্নকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে তার ভাগ্য যে কতটা ঐশ্বর্যমণ্ডিত আর ফুল্ললিত ছিল তা কখনো বুঝতেই পারেনি সে! তাই সংসারে ঘটে চলা পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরূদ্ধে স্ত্রীর একক প্রতিবাদের সময় স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানোর কথা মনেই হয়নি তার!
কারণ সংসারে মেয়েদের আসল সৌন্দর্য কোথায়, কী তার স্বরূপ, তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে কোনোদিন সেই তত্ত্বটা জানতেই দেয়নি! তাই বৈবাহিক সনদে স্ত্রীকে কাছে পেলেও একমুহূর্তের জন্যও নিজের স্ত্রীর মনের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছানোর সুযোগ হয়নি এই হতভাগ্য স্বামীটির। এবং পুরো গল্পের পরিসরে তার সেই দুর্ভাগ্যের উপলব্ধি ঘটার সুযোগটাও ঘটলো না। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছাকৃতভাবেই এই চরিত্রটির শোচনীয় অবস্থা করে ছাড়লেন।
আসলে ঊনবিংশ শতকের বঙ্গসমাজের অধিকাংশ পুরুষের এরকমই শোচনীয় অবস্থা ছিল। তারা জানতেও পারেনি কতটা অপূরণীয় ক্ষতির মধ্য দিয়ে আজীবন একছাদের তলায় কাটিয়েও নারীর পরিপূর্ণ সত্তার পরশ থেকে বঞ্চিত থাকলো তারা। তাই বলা যায়, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পটা শুধুই মৃণালের গল্প নয়, একই সাথে হয়তো আরোও গভীরভাবে তার পতিদেবতাটিরই গল্প, যে গল্পটিকে কবিগুরু অকথিতই রেখে দিয়েছেন তাঁর কুশলী সাহিত্যিক ঋদ্ধিতে আগ্রহী পাঠকের নিবিষ্ট পাঠের সম্ভাবনায়।
এবারে আসি ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর স্বামী অপুর চরিত্র বিশ্লেষণে। মৃণালের স্বামী থেকে কিছুটা উন্নত চরিত্রের হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামনে সর্বতোভাবে সেই মিনমিনে স্বভাবেরই। মৃণালের স্বামী স্ত্রীর যে সত্য কোনোদিন উপলব্ধিই করতে পারেনি, সেই সত্যটি উপলব্ধির অনেকটা নিকটে গিয়েই পৌঁছেছিল হৈমন্তীর কলেজ পড়ুয়া স্বামী, যার এই উপলব্ধির উচ্চারণ দিয়েই আজকের আলোচনাটা শুরু হয়েছে।
বিয়ের সময়েই হৈমন্তীর স্বামী অপুর স্পষ্ট ধারণা জন্মেছিল যে, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিয়ে করেও নারীকে যথার্থ রূপে পাওয়া যায় না। স্ত্রী হলেও তাকে চেনা হয় খণ্ডিতরূপেই। তার নিজের কথাতেই, ‘আমি কিন্তু বিবাহসভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো আনাই বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না।এবং জানেও না যে, সে তাকে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না’।
শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিকে হৈমন্তীর আদর যত্নের কোনো অভাব না ঘটলেও কিন্তু ক্রমেই তাতে বিঘ্ন ঘটতে লাগলো। হৈমন্তীর শ্বশুরমশাই যখন জানতে পারলেন যে, হৈমন্তীর বাবার সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে তার ধারণাটা নিতান্তই কাল্পনিক ছিল, রাজদরবারে কাজ করলেও বেয়াই একজন সাধারণ শিক্ষক মাত্র, তখন পুত্রবধূটির উপর থেকে নিমিষেই সকল স্নেহ উবে গেল! যত রাগ, ক্ষোভ সবকিছু গিয়ে পড়লো তার উপর। ফলস্বরূপ, অনাদরে, অবহেলা আর অপমানে হৈমন্তীর জীবনপ্রদীপ ক্রমশই শুকিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু হৈমন্তীর স্বামী সবকিছু বুঝেও পিতৃতান্ত্রিক অভিশাপের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারলো না। রক্ষা করতে পারলো না তার প্রিয়তমা স্ত্রীর আত্মসম্মানটুকু।
একপর্যায়ে হৈমন্তীর স্বামীর জন্য নতুন উদ্যমে বিত্তশালী ঘরের পাত্রী সন্ধানের সংবাদের মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটলো ‘হৈমন্তী’ গল্পের।
রবীন্দ্রনাথ দেখালেন, পুরুষতন্ত্র কিভাবে পুরুষরা মেরুদণ্ডটিকেই কব্জা করে রাখে, দুর্বল করে রাখে। সোজা হয়ে, স্বাধীন ভাবে উঠে দাঁড়াতে দেয় না। তাই নিরপরাধ হৈমন্তীর জন্য, তার ভালোবাসার জন্য সব জেনে বুঝেও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, স্বাধীন আত্মপ্রত্যয়ের সাথে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকু হলো না গল্পের নায়কের। এমনই দৃঢ় এই পুরুষতান্ত্রিক শৃংখল! এবারে আসি, মেয়ে হয়েও পুরুষতন্ত্রের শৃংখলটা কেটে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর এক অপরূপ গল্প ‘অপরিচিতা’ র আলোচনায়।
গল্পের নায়ক অনুপম সাতাশ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবক। কিন্তু যুবক হলেও মামার কড়া শাসনের বিপাকে পড়ে মানসিকতাটা নাবালকত্বের সীমানাতেই আটকা পড়ে আছে। তাইতো বিয়ের আসরে যখন কনের গা থেকে সমস্ত স্বর্ণ খুলে নিয়ে খাঁটি কিনা দেখার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চললো, তখন অনুপমের ব্যক্তিসত্তা মামার এই ঘোরতর অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেনি।
মেয়েকে বিয়ে দিলেও আত্মসম্মানে বলীয়ান, শান্ত স্বভাবের এবং কম কথার মানুষ, শম্ভুনাথুবাবু কিন্তু নিজেকে কখনোই কন্যাদায়গ্রস্ত বলে মনে করেননি। তাইতো বরের মামা কর্তৃক ঘটানো এই অপমানের জবাব তিনি দিয়েছিলেন অন্যভাবে।
বিয়ের লগ্নের আগেই পাত্রপক্ষকে পেটপুরে খাইয়ে দাইয়ে অনুপমের দুর্জন মামাকে জানালেন, ‘আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে, তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে আরি না’।
গল্পে এর পরের ঘটনাটা হলো ভীষণ রোমাঞ্চকর!
বেশ কিছুদিন পর অনুপম তার মাকে নিয়ে তীর্থে যাওয়ার পথে হঠাৎই ট্রেনের কামরায় দেখা হয়ে গেলো শম্ভুনাথ বাবুর সেই অবিবাহিতা মেয়েটার সাথে। সেই প্রথম নারীর তেজস্বী আর স্বাধীন রূপের সাথে পরিচয় ঘটে অনুপমের!
মামার অভিভাবকত্বের সীমানা ডিঙিয়ে এরপর অনুপমের পুরুষ হয়ে ওঠার চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ।
কলকাতার পাঠ চুকিয়ে মামার শাসন অগ্রাহ্য করে অনুপম চলে এসেছে শম্ভুনাথবাবুর শহরে, কল্যাণীর কাছে। কিন্তু কল্যাণীর কঠিন পণ, সে আর বিয়ে করবে না। অসহায় মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্রতেই সে আত্মনিয়োগ করেছে। অনুপমও কল্যাণীর সেই মহান ব্রতের কাজে তার নিরুদ্বিগ্ন হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেখানেই সে খুঁজে পেয়েছে তার পুরুষার্থের মূল ঠিকানা। এভাবেই পুরুষতন্ত্রের শেকল কেটে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা নারীকে তার সত্য মূল্যে অনুভব করার উপলব্ধির শক্তিটুকু পুরুষের চেতনায় সঞ্চারিত করার সংবেদী আলো জ্বেলে দিয়ে গেলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যকীর্তির নিপুণ লিখনশৈলীর মুন্সিয়ানায়। কবিগুরু তাঁর এই তিনটি ছোটগল্পের ধারাবাহিকতায় পুরুষতন্ত্রের অভিশাপে নারীর অবরুদ্ধ ব্যক্তিসত্তা ও নিষ্পেষিত জীবনের যন্ত্রণা এবং বিপরীতে পুরুষতন্ত্রের শৃঙখলে বনসাই হয়ে থাকা অমেরুদণ্ডী পুরুষের আত্মপ্রত্যয়ের ঠিকানা সন্ধানের সূত্রটুকুও দিয়ে গেলেন তাঁর পাঠকদের। ১৩২১ বঙ্গাব্দের তিনমাসে লেখা তিনটি অনবদ্য ছোটগল্পের মধ্যে ধরা থাকলো আবহমান পুরুষতন্ত্রের অভিশাপে অভিশপ্ত বঙ্গ সমাজেরই এক নিদারুণ চালচিত্র ! থাকলো সেই অভিশাপ থেকে মুক্তিরও হদিশ!
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার