নগরের পৃথক চারটি ফ্লাইওভারকে ঘিরে সৌন্দর্যবর্ধনে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৯ ও ২০২০ সালে পৃথক দুটি চুক্তি করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ চুক্তির মেয়াদ আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ চুক্তি বাতিল না করে ফ্লাইওভারগুলোসহ শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক নতুন করে সৌন্দর্যবর্ধনে গত মাসে দরপত্র আহ্বান করে চসিক। বিষয়টিকে ‘আইনবহির্ভূত’ দাবি করে উচ্চ আদালতে রীট করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। আদালত তা আমলে নিয়ে দরপত্রে উল্লেখ থাকা ফ্লাইওভারে নতুন করে সৌন্দর্যবধনের উপর স্থগিতাদেশ দেয়। একইসঙ্গে চসিককে একমাসের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেয়। গতকাল সোমবার এ আদেশের কপি পাঠানো হয়েছে চসিকে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, দরপত্র আহ্বানের আগে ফ্লাইওভারের সৌন্দর্যবর্ধনের মেয়াদ বৃদ্ধি ও রাজস্ব সমন্বয় করার লক্ষ্যে সংস্থাটির আইন কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক ও নগরপরিকল্পনাবিদকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, বাৎসরিক কর ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৫ বছরে চূড়ান্ত হিসাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি চসিক থেকে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা প্রাপ্য। চসিক স্থান বুঝিয়ে দিতে না পারার কারণে কিংবা দখল দিতে না পারার কারণে অথবা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি আয় বঞ্চিত হয়েছে ধরে এ অর্থ নির্ণয় করা হয়।
ফ্লাইওভার চারটি হচ্ছে– আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার, এম এ মান্নান চৌধুরী ফ্লাইওভার, কদমতলী ফ্লাইওভার ও দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার এবং বাকি তিনটি ফ্লাইওভারে সৌন্দর্যবর্ধনে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি ‘ট্রেড ম্যাক্স’ এর সাথে চুক্তি করে চসিক। পাঁচ বছরের জন্য এ চুক্তি করলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ট্রেড ম্যাক্সকে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের বিপরীতে বছরে ১ কোটি টাকা এবং বাকি ফ্লাইওভারগুলোর জন্য বছরে মাত্র ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। ওই হিসেবে পাঁচ বছরে চসিকের আয় হওয়ার কথা মাত্র ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বছর ট্রেড ম্যাক্স মাত্র ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধ করে। বাকি টাকা করোনাজনিত মন্দ পরিস্থিতির কারণে চসিক ট্রেড ম্যাঙকে মওকুফ করে দেয়। বাকি চার বছরে চসিক ট্রেড ম্যাঙের কাছ থেকে পাবে ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া কদমতলী, দেওয়ান হাট ও এম মান্নান ফ্লাইওভারের বিদ্যুৎ বিল ট্রেড ম্যাঙের দেয়ার কথা কথা থাকলেও পরিশোধ করতে হয় চসিককে। এতে বছরে ৩০ লাখ টাকা হিসেবে ৫ বছরে চসিকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন খাতে ট্রেড ম্যাঙের আর্থিক ক্ষতি দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির শর্ত অনুসারে ট্রেড ম্যাঙ ১০টি পাবলিক টয়লেট করার কথা থাকলেও করেছে একটি। তবে এক্ষেত্রে চসিক জায়গা নির্ধারণ করে দিতে পারেনি বলে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে ১০৬টি হকার শেডের একটিও করা হয়নি। এ বিষয়ে ‘ঠিকারদারকে হকার শেড লিজ দেয়া কর্পোরেশনের জন্য শোভনীয় নয় এবং এটি কর্পোরেশনের ম্যান্ডেট বর্হিভূত’ বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
এদিকে ২৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন দেন মেয়র। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ‘সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিভিন্ন সড়ক, মিডিয়ান, ফুটপাত, ফুটওভার, সড়কদ্বীপ, ফ্লাইওভার–এর উপর ও নীচের অংশ, ফুটওভার পরিত্যক্ত খালি স্থান, উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়, সৌন্দর্যবর্ধন সবুজায়ন ও ল্যান্ডস্ক্যাপিং এবং রক্ষণাবেক্ষনের জন্য বিভিন্ন সংস্থা অথবা প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির কাছ থেকে ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রস্তাব’ আহ্বান করে। রোববার ছিল দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। এতে ৪০০ এর অধিক প্রস্তাব জমা পড়ে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
এদিকে চসিকের বিজ্ঞপ্তিকে আইনবর্হিভূত দাবি করে ৩০ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতে রীট করেন ট্রেড ম্যাঙের স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ হেলাল আহমেদ। ৭ জানুয়ারি বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন ও কে এম রাশেদুজ্জামান রাজার বেঞ্চ বিজ্ঞপ্তির ফ্লাইওভার অংশের উপর ৩ মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। আদেশের কপি ৯ জানুয়ারি চসিকে হস্তান্তর করেন হেলাল আহমেদ। এছাড়া রেজি: করে পাঠানো আদেশের কপি গতকাল রিসিভ করে চসিক।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, মেয়র মহোদয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দিবেন সেভাবেই হবে। আইনগত বিষয়টিও আমরা মোকাবেলা করব।
জানতে চাইলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদত হোসেন আজাদীকে বলেন, শুধু ফ্লাইওভার নয় আওয়ামী লীগের আমলে যেসব চুক্তি হয়েছে সবগুলো বাতিল করব। কারণ ওই সময় কর্পোরেশনের স্বার্থের বাইরে গিয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে চুক্তিগুলোতে। ফ্লাইওভারে নতুন করে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগের উপর আদালতের স্থগিতাদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের আইন কর্মকর্তা ও আইনজীবী আছেন। তাদেরকে বিষয়টি দেখতে বলেছি। সেটা আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করব। সাথে নতুন করে সৌন্দর্যবর্ধনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই বাস্তবায়ন করব।
আনুষ্ঠানিকভাবে পুরনো চুক্তি বাতিল না করার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমরা মিটিংয়ে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর অর্থ বাতিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। পাশাপাশি তাদের চিঠিও দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, যারা বর্তমানে আছেন তারা যদি আইন–কানুন মেনে এবং কর্পোরেশনের স্বার্থ মেনে আবেদন করেন সেটাও আমরা বিবেচনায় করব।
ট্রেড ম্যাঙ–এর স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ হেলাল আহমেদ আজাদীকে বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়নি। আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবেও জানানো হয়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে জানতে পারি নতুন করে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অথচ সর্বশেষ মাসেও বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গার্ডেনিংসহ অন্যান্য কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছি। তাই বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতে রীট করি। আদালত ৩ মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। কর্পোরেশন চুক্তি বাতিলে আমাদের নোটিশ দিলেও সময় দিতে হবে। তদন্ত করে আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি নিরুপণ করা হয়েছে সেগুলো তো অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কর্পোরেশন জায়গা দিতে না পারায় যাত্রী ছাউনি, পাবলিক টয়লেট, হকার শেডসহ কিছু কাজ আমরা করতে পারিনি। এখানে আমাদের দোষ নেই।