পুরনো আসনে খসরু, বাবার আসনে সাইদ আল নোমান

আসলাম চৌধুরী পেলেন চূড়ান্ত মনোনয়ন চট্টগ্রামে দুই আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে তার পুরনো আসনে (চট্টগ্রাম১১) চূড়ান্ত করল বিএনপি। এই সংসদীয় এলাকা থেকে ছয়টি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবার বিজয়ী হয়েছেন তিনি। এর আগে তাকে চট্টগ্রাম১০ আসনে প্রার্র্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এখন আসনটিতে নির্বাচন করবেন জাতীয়তাবাদী পাট শ্রমিক দলের সভাপতি সাঈদ আল নোমান। তার বাবা বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান দুটি সংসদ নির্বাচনে (নবম ও একাদশ) অংশ নেন চট্টগ্রাম১০ আসন থেকে। অর্থাৎ বাবার আসনে পুত্রকে বাছাই করল বিএনপি।

এদিকে চট্টগ্রাম৪ আসনেও (সীতাকুণ্ড এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯ ও ১০ নং ওয়ার্ড) প্রার্থী পরিবর্তন করেছে বিএনপি। আসনটিতে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা লায়ন আসলাম চৌধুরী। এর আগে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সালাউদ্দিনকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেয়া হয় এ আসনে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রথম দফায় গত ৩ নভেম্বর ১০টি আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন দেয় বিএনপি। এদিন চট্টগ্রাম১০ আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম৪ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় কাজী সালাউদ্দিনকে। দ্বিতীয় দফায় ৪ ডিসেম্বর আরো তিনটি আসনে দলের মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। যেখানে ছিল না চট্টগ্রাম১১। এর মধ্যে চট্টগ্রাম১১ আসন থেকে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন আমীর খসরুর ছেলে ও বিএনপির স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপার্সন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু ও নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান। তারা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেন।

এদিকে শুরু থেকেই চট্টগ্রাম১০ আসনে সাঈদ আল নোমান ও চট্টগ্রাম৪ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন আসলাম চৌধুরী। আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবিতে তার সমর্থকরা চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেন। সর্বশেষ গতকাল শনিবার আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাঈদ আল নোমান ও আসলাম চৌধুরীকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়ার চূড়ান্ত চিঠি দেয়া হয়।

প্রার্থী সম্পর্কে : পূর্বে কোনো দলীয় পদ ছিল না সাঈদ আল নোমানের। রাজনীতিতেও প্রকাশ্যে সক্রিয় ছিলেন না তিনি। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাবা আবদুল্লাহ আল নোমান মারা গেলে রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হন তিনি। এরপর ২৯ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী পাট শ্রমিক দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। এছাড়া চট্টগ্রাম১০ আসনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে উপস্থিতি বাড়ে। অল্প সময়ের মধ্যে বাবার অনুসারীদের আস্থার জায়গায় পৌঁছান তিনি।

এদিকে আমীর খসরু চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় ঐক্যজোট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে ১০ অক্টোবর ২০০১ সালে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। আমীর খসরু চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

এদিকে আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে জিয়া পরিষদ চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি এবং উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য হন। ২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদ পান। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ১৫ জুন তাকে যুগ্ম মহাসচিব থেকে সরিয়ে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা করা হয়। তিনি ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন চট্টগ্রাম৪ আসন থেকে। একই আসন থেকে কারাগার থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী হন আসলাম চৌধুরী। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৫ মে গ্রেপ্তার হন তিনি। ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট কারামুক্ত হন। যদিও মোসাদ কানেকশনের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ দাবি করা হয়।

কী বলছেন প্রার্থী ও সমর্থকরা : সাঈদ আল নোমান আজাদীকে বলেন, আল্লাহর রহমতে জনগণের চাওয়া পূরণ হয়েছে। মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এজন্য আমি গভীরভাবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞ। একইসঙ্গে আমি মনে করি, এটি আমাদের পরিবারের নিষ্ঠা ও আদর্শিক রাজনীতির প্রতি দলের মূল্যায়ন।

তিনি বলেন, সোশ্যাল ওয়ার্কের এঙটেনশন হচ্ছে পলিটিঙ। জনগণ যদি সুযোগ দেয় জনসেবা করব। আমার কাজগুলোর পেছনে সবসময় চিন্তায় থাকে জনসেবা। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আশেপাশের মানুষের সমস্যার সমাধান করা এবং তাদের সহযোগিতা করা। এখন সে দায়িত্ব আরো বেড়ে যাচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে যদি সুযোগ পাই তাদের জন্য বাকিটুকু করব। আমাদের দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের অনেক রোল প্লে করতে হবে, সেখানে কন্ট্রিবিউট করার চেষ্টা থাকবে।

চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়ার পর আসলাম চৌধুরী বলেন, দল আমার ওপর যে আস্থা রেখেছে, তা দলের নেতাকর্মী ও জনগণের ত্যাগের ফসল। তারা চেয়েছেন বলেই প্রাথমিকভাবে ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তন করে আমাকে চূড়ান্ত করেছে। এই আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

সদরঘাট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাজী সালাহ উদ্দীন আজাদীকে বলেন, জনগণের প্রত্যাশা ছিল চট্টগ্রাম১১ আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে মনোননয়ন দেয়া হোক। কারণ তিনি একজন সৎ এবং ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ক্লিন ইমেজের অধিকারী। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবেন তিনি।

আসন সম্পর্কিত : চট্টগ্রাম১১ আসনটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৭ থেকে ৩০ এবং ৩৬ থেকে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। পতেঙ্গা, বন্দর, সদরঘাট ও ইপিজেড থানা এবং ডবলমুরিং থানার একাংশ পড়েছে চট্টগ্রাম১১ আসনে। চট্টগ্রাম১০ আসনটি সিটি কর্পোরেশনের ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ২৫ ও ২৬ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। নগরের পাহাড়তলী, ডবলমুরিং আংশিক, খুলশী, হালিশহর ও পাঁচলাইশ (আংশিক) অংশবিশেষ পড়েছে এ আসনে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আসন দুটো (১০ ও ১১) একসঙ্গে ছিল। তখন এটা পরিচিত ছিল চট্টগ্রাম৮ আসন হিসেবে।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে নবম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম১১ থেকে আমীর খসরু ও চট্টগ্রাম১০ থেকে অংশ নেন আবদুল্লাহ নোমান। দুটো নির্বাচনেই পরাজিত হন তারা। এর মধ্যে আমীর খসরু আওয়ামী লীগের এম এ লতিফের কাছে এবং নোমান পরাজিত হন আওয়ামী লীগের ডা. আফছারুল আমীনের কাছে।

২০০৮ সালের পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম এ মান্নান, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সুলতান আহমেদ চৌধুরী, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের ইসহাক মিয়া ও ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লিয়াকত আলী নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিজয়ী হন। ওই সময় আমীর খসরু বেগম জিয়ার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে একই বছর নির্বাচনী এলাকায় উপনির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে (ষষ্ঠ ও সপ্তম) ও ২০০১ সালে অষ্ঠম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও খসরু সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তৎকালীন চট্টগ্রাম৮ আসন থেকে।

এদিকে চট্টগ্রাম৪ তথা সীতাকুণ্ডের পরিচিত আছে চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে। নগরের সীমানার সঙ্গে যুক্ত এ উপজেলা। তবে নির্বাচনী আসন বিন্যাসে সিটি কর্পোরেশনের ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড আসনটির অন্তর্ভুক্ত। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার অংশ এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির এল কে সিদ্দিকী, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জেএসডির আইনুর কামাল, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত দুটো নির্বাচনে বিএনপির এল কে সিদ্দিকী, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এবিএম আবুল কাশেম, ২০০১ সালে বিএনপির এল কে সিদ্দিকী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের এবিএম আবুল কাশেম, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের দিদারুল আলম এবং ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এসএম আল মামুন নির্বাচিত হন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখালেদা জিয়া সংকটময় মুহূর্ত পার করছেন : ডা. জাহিদ
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে আগুনে পুড়ল ২০০ বছরের পুরানো বাড়িসহ ১২টি বসতঘর