পাহাড়ে বেড়াতে গেলেই জুমের শাক আনাজ কিনতে না পারলে আমার শান্তি লাগে না। তাই যখনই আমি রাংগামাটি যাই বনরূপা বাজার, আসামবস্তি বাজার কিংবা রাস্তার ধারে বসে জুম্ম নারীদের হাটে ঢুঁ মারবোই। সেদিন লেকের জলে টইটুম্বুর রাংগামাটির যে অপরূপ মাধুরী দেখে এসেছি, তা ভোলার নয়। এমন টুপ টুপ জলে ভরা লেক আর সুরম্য ছোটবড় পাহাড়মালায় ঘেরা অপরূপ এক রাংগামাটি আমার চোখে আজীবন দৃশ্যমান থাকবে। আমরা যারা চট্টগ্রামের বাসিন্দা পাহাড় সমুদ্র আর সমতট আমাদের হাতের মুঠোয়। তাই কত শতবার যে এই সুন্দরের অনাবিল হাতছানি আমায় টেনে নিয়ে যায়, তার হিসেব নেই। সেদিন মেঘ আর বৃষ্টির দোলাচলে ভাসতে ভাসতেই বন্ধু ফরিদার আমন্ত্রণে ছুটে যাই রাংগামাটি। ইচ্ছে ছিল শরতের নীল মেঘমালা বা কাশবনের সাথে মিশে যাবো! ঘাসফুল আর তৃণ লতার সাথে মিতালী করবো। ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির বর্ণিল ছোঁয়ায় আমার ফেলে আসা দুরন্ত শৈশবে ডুবে যাবো। কিন্তু প্রকৃতি তখনো বর্ষার আমেজে মগ্ন। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার বদলে বিদ্যাপতি আর কালিদাশের মেঘেদের ছুটাছুটি! তাই বিন্দ্যা পর্বত, রামগিরি আর অলকা, কালিদাশ, বিদ্যাপতি, রাধিকা, যক্ষপ্রিয়া এসে আমার মনোজগতকে কোনো এক সীমাহীন অতীতে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেলো। কাছের পাহাড়মালা দৃষ্টি সীমানায় ছিল, কিন্তু দূরের সব পাহাড় বহুদূরে, ধূসর আর অস্বচ্ছ। তবে মায়া ছড়ানো। যে মায়া দেখা যায় না, কেবল অনুভবের। লেকের নীল জলরাশি বানের জলের মতো ঘোলা। কখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, কখনো বা ঝুম বৃষ্টিতে পাহাড়মালা চোখের আড়ালেই ঢাকা পড়ছিল। এমনই পরিবেশে বনরূপা বাজারে আমি ঘুরছিলাম একাকী। হাটবার না হলেও এখানে জুম্ম নারী পুরুষ তাদের খেতের শাক–আনাজ নিয়ে বসে। এটি বিশাল হাট। সমতল থেকে সোজা রাস্তা একেবারে খাড়া পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে। এই বাজারের শেষ প্রান্তে গৈরিকা দি’র বাড়ি। চমৎকার বাড়িটি নানা নান্দনিকতায় ভরা। বন্ধু আল্পনার বড় বোন তিনি। আমি হাটের দুপাশ দেখে দেখেই পথ চলছি। কি টাটকা শাক আনাজ এ ভরা এই বাজার। চলছি আর দেখছি। হঠাৎ এমন ঘনঘোর মেঘে ঢেকে গেলো আকাশ। শুরু হলো বৃষ্টি। আমার সাথে ছাতা ছিল না। কিছুক্ষণ ইচ্ছে করেই ভিজেছি। পরে কাকভেজা হওয়ার আগেই আনাকে বসার জন্য জায়গা করে দিল পুতুলি চাকমা। তারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই মিলেই সওদা করে। আদা ফুল, হলুদ ফুল, কলার থোড়, জুম্মা বেগুন, বিনি কচু,খটখটে শুকনো হলুদ,কচি লাউ কত কত সবজি। আমি সব সবজিই পুতুলির কাছ থেকে কিনলাম। এদিকে বৃষ্টির দাপট বেড়েই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। ওর জীবন যাপনের কাহিনী গল্পের ছলেই জেনে নিলাম। পাহাড়ে প্রেম ভালোবাসা সমতটের মতো মসৃণ না। এরা পাহাড়ের মতোই কঠিন বটে, তবে সারল্য আর আন্তরিকতায় এরা এক ধাপ এগিয়ে। এক কথার মানুষ। যা বেচবে সেই দামই বলবে। কোনো প্রকার ফন্দি ফিকির আর প্রতারণার ধারে কাছে নেই। পুতুলিই আমাকে সব সবজি বাছাই করে দিচ্ছিল। আমি তার পাশে মেঝেতে বসেছি আরাম করে। বৃষ্টির শীতল পরশে সে নিজেকে চাংগা করতে ডাবায় (বাঁশের হুক্কা) সুখ টান দিচ্ছিল। আমাকেও অফার দিল টানতে। প্রচুর শাক আনাজ বিক্রি করে ৭/৮ শ টাকা পেয়ে কি খুশি! আমাকে ওর স্বামী রংগু চাকমা বাজারের ব্যাগ কিনে দিল, আবার এমন বাদল ধারায় একটি সিএনজিও ঠিক করে দিল। আমি তাকে খুশি করতে চাইলে, সে দান সে কিছুতেই নিল না। তারা একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। বনরূপার অদূরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অনেক নীচে তাদের পাড়া। জ্বালানী হিসেবে কাঠ আর ঝিরির জলই তাদের ব্যবহারের মূল উৎস। আর জুমের ধান চাল তরিতরকারি ফলমূল,মাছ, বন মোরগ আর শূকর এদের প্রধান খাদ্য। তেল মশলা ছাড়াই তাদের রান্না হয়। গুরুপাক করে না। অনেকটা আধাকাঁচা রান্না হয় তরকারি। তবে মুরগী, হাঁস খুব ঝাল করে রান্না করে। মরিচের ভর্তা, শুটকির ভর্তায় প্রচুর ঝাল থাকে। কঠোর পরিশ্রম করে বিধায় সুঠাম শরীর। বয়সে নবীন পুতুলী দুই সন্তানের জননী। মুখে অনবরত হাসির ঝিলিক। আমার সাথে গল্প করেই খুশি। এদের ভাষা তুই। তুমি, আপনি ওরা বলেনা। আমাকে বললো তোকে খুব ভালো লেগেছে। তুই আবার আসবি। তোকে আমাদের পাড়ায় নিয়ে যাবো। কিন্তু আমি তো এখন ওর মতো নবীনা না, আমি পাহাড়ের সরু পথ ধরে সেই ছায়া ঘেরা বন বীথি পথে অনেক নীচে কিভাবে নামবো? তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলাম, বললো একটু বড় হলেই পাড়ায় স্কুল আছে, সেখানে ভর্তি করাবে। উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পায় কিনা জিজ্ঞেস করলাম। বললো, আমরা গাছের পাতা গাছের ছাল ছাড়া বিভিন্ন ঔষধি লতাপাতা খুব খাই, বাচ্চাদেরও সেইভাবে অভ্যস্ত করে ফেলি। তাই খুব একটা অসুখ বিসুখ হয়না। ধীবর পল্লীর কুবের আর কপিলা কে মনে পড়লো। বুঝলাম “জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব ও বিষন্ন”। এরপরেও পুতুলির চোখে মুখে অনাবিল হাসির ছটা আমায় মুগ্ধ করলো। কি কঠিন তাদের জীবনযাত্রা। কোনো ভোগ বিলাসের বালাই নেই। যেন পাহাড়ই তাদের শান্তির নীড়। পাহাড়ের বিশালতা আর উদারতায় তাদের জীবনচলার এক মাত্র পাথেয়। আমি এই ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ব্যাগ ভর্তি শাক পাতাসহ পুতুলির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ছুটলাম আসাম বস্তির দিকে। ভর দুপুরে পাহাড়ি নির্জন বনপথে আমি একাকী। আমার বাহনের বাহকই আমার সংগী। রাংগামাটির সেই রাস্তাটি, যার দুপাশে লেকের ফেনিল জলরাশি। সে এক অপূর্ব দৃশ্যপট। বাহন থেকে নেমে সুন্দর স্পটে ছবি তুললাম। জমা রাখলাম স্মৃতির সিন্দুকে। বাহকই এখানে আমার ছবি তুলে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে। বেশ কিছুক্ষণ আসাম বস্তির ব্রিজে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অসামান্য সুন্দরে মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম। প্রবল বৃষ্টির কারণে রাস্তার এপার ওপার জলে একাকার। জল স্ফীত হয়ে রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মনের সুখে পা ভিজালাম। মনে হচ্ছিল যেনো মহা সাগরের তীরে এসে আমি দাঁড়ালাম। নিরিবিলি আর নির্জনতা এতো সুন্দর। কিছু পাখপাখালি, জল আর বাতাসের অপূর্ব মূর্ছনা ছাড়া এখানে আর শব্দ নেই। এদিকে বন্ধু ফরিদা তার কাজ সেরে ফোন দিচ্ছিল। সেই অমৃত সম খাবারের রাজ্য ‘পাজন ’ এ যাবার জন্য। আমি আসাম বস্তি থেকে ‘পাজন’ অভিমুখে ছুট দিলাম। বিদায়বেলায় কবির সেই গানটি মনে পড়লো, “তোমার কথা হেথা কেহ তো বলেনা, করে শুধু মিছে কোলাহল, সুধা সাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে মিছে হলাহল…”