পুঁথি সাহিত্যকে গৌরবান্বিত করেছে বাংলার মুসলিম সমাজ

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | সোমবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

পুঁথি আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। বর্ণমালা আবিষ্কারের পর প্রাচীন সাহিত্য ছিল হস্তলেখানির্ভর। প্রাচীন যুগে একে বলা হতো ‘পুস্তক’। আর এই পুস্তক শব্দটি এসেছে ‘পোস্ত’ বা ‘পুস্ত’ থেকে। যার অর্থ চামড়া। চামড়া বা পুস্তক এর ওপর লেখা হতো বলে প্রাচীন সাহিত্যে একে পুস্তক বলা হতো। ‘পুস্তক’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত। আর এই সংস্কৃত ‘পুস্তক’ থেকে পুঁথি শব্দটি এসেছে। পুঁথি আর পুস্তক শব্দ দুটো সমার্থক। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথিগুলো সাধারণত ভূর্জছাল, কাপড়ের পটে, তেরেট পাতা, তালপাতায় লেখা হতো।

আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখনকার সময়ে হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সব সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা হয়।

পুঁথিসাহিত্য আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক বিশেষ শ্রেণির বাংলা সাহিত্য। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। এ সাহিত্যের বেশিরভাগ রচয়িতা ও পাঠকই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের।

পুঁথি একসময় মুখে মুখে রচিত হতো। লোককাহিনির মতোই পুঁথির জন্ম। পরবর্তী সময়ে লিখে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। হুগলির বালিয়াহাফেজপুরের কবি ফকির গরীবুল্লাহ ‘আমীর হামজা’ রচনা করে এ কাব্যধারার সূত্রপাত করেন। পুঁথি সাধারণত কোনো একটি কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত। বাংলাদেশেও পুঁথিসাহিত্যের বেশ সুনাম রয়েছে। পুঁথিসাহিত্যপরবর্তী সময়ে গ্রামবাংলায় পাঠ করতেন গ্রামের কিছু পাঠক। তাঁরা সুর করে পাঠ করতেন পুঁথি। একটি পুঁথি পাঠ করে শেষ করতে লেগে যেত অনেকদিন। কখনো কখনো মাসও পার হয়ে যেত। নানা অঙ্গভঙ্গি আর হাস্যরসাত্মক কথার মধ্য দিয়ে পুঁথিপাঠ হতো। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি, যিনি পুঁথিপাঠ জানতেন ও এর কাহিনি সম্পর্কে অবগত, তিনিই পাঠ করতেন। সবাই নির্ধারিত সময়ে পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসতেন। হারিকেনের টিমটিমে আলোয়, জলচৌকিতে পুঁথি রেখে পাঠক আসন করে বসতেন। চারদিকে সবাই নীরব। পুঁথিপাঠে পাঠকের সুর একটি মুখ্য বিষয় ছিল। পুঁথির সুরটি অন্যান্য সুর থেকে একটু আলাদা। পুঁথির কিছু অংশ পাঠ করে এর সারসংক্ষেপ পাঠক উপস্থিত দর্শকদের বুঝিয়ে দিতেন কথার মাধ্যমে। পাঠক নানান কথা দিয়ে বর্ণনা করে পুঁথিপাঠের পুরো সময়টি মাতিয়ে রাখতেন।

এ সাহিত্যের অধিকাংশ রচয়িতা এবং পাঠক ছিল মুসলমান সম্প্রদায়।

পুঁথিপাঠ সাধারণত রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হতো। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে অবসর সময়ে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতেন। তারপর সেখানে উপস্থিত হতেন পুঁথিপাঠকেরা। অনেক পুঁথিসাহিত্য বাংলায় নামকরা ছিল। ‘গুলেব কাওলি’, ‘চর্যাপদ’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘লাইলী মজনু’, ‘ইউসুফ জুলেখা’সহ বহু পুঁথিসাহিত্য ছিল, যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

আগে উল্লেখ করা হয়েছে, হুগলির বালিয়াহাফেজপুরের কবি ফকির গরীবুল্লাহ মিশ্র ভাষার রীতিতে যুদ্ধবিষয়ক কাব্য ‘আমির হামজা’ রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এ কাব্যময় পুঁথির সূচনা করেছিলেন। যারা পুঁথি রচনা করতেন তাদের বলা হতো শায়ের। শায়ের আরবি শব্দ। যার বাংলা প্রতিশব্দ কবি। বহু পুঁথি আজ সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত ‘পুঁথি সংগ্রহ সমিতি’র তত্ত্বাবধানে নলিনী ভট্টশালী ১৭ হাজার পুঁথি সংকলন করেছিলেন। অধ্যাপক আহমদ শরীফ সম্পাদিত পুঁথি পরিচিতি গ্রন্থে ১০০ কবির প্রায় ২০০ পুঁথির তালিকা রয়েছে। এছাড়া অধ্যাপক আলী আহমদ মুদ্রিত কলমী পুঁথির তালিকায় রচিয়তার নামসহ ৫৬৯টি পুঁথিকাব্যের সংকলন পাওয়া যায়।

ইউসুফজুলেখা’ লিখে রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের সূচনা করেন কবি মুহাম্মদ সগীর। পরে অন্য মুসলিম কবিরা এ ধারায় লিখতে শুরু করেন। ১২৭১ সালে মুন্সী মুহাম্মদ লিখেন ‘লায়লামজনু’। ১৩৬৯ সালে মুন্সী খালেক মুহাম্মদ লিখেন ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’। ১৩১৭ সালে মুনশী কমরুদ্দিন লিখেন বেনজিরবদরে মুনীর। জঙ্গনামা কাব্যে রয়েছে আরবইরানের ইসলামপূর্ব ও ইসলাম উত্তর যুগের বীর পুরুষদের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্য জয় ও ইসলাম প্রচারের বর্ণাঢ্য বিবরণ। ১৩৬৮ সালে ইমাম হোসেনের শাহাদাত নিয়ে মোক্তার হোসেন লিখেন ‘ছহি বড় জঙ্গনামা’। ১৩৩৬ সালে মুন্সী মাজহার আলী লিখেন ‘শাহাদতনামা’। ১৩৬০ সালে মুন্সী জোনাব আলী লিখেন ‘জঙ্গে খয়বর’। এতে খায়বার বিজয়ের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এ শ্রেণির কাব্যের মধ্যে রয়েছে আমীর হামজা, জৈগুনের পুঁথি, হাতেম তাই প্রভৃতি গ্রন্থ।

ঐতিহাসিক নবী, পীর, আউলিয়ার জীবনকথা, চরিত্রমাহাত্ম্য ও ধর্মপ্রচার নিয়ে রচিত হয়েছে নবীআউলিয়ার জীবনীকাব্য। সুলতান ইউসুফ শাহের সভাকবি শেখ জৈনুদ্দিন লিখেন ‘রাসূল বিজয়’। শেখ ফয়জুল্লাহ মুজাহিদ দরবেশ শেখ ইসমাইল গাজীর জীবন অবলম্বনে লিখেন ‘গাজীবিজয়’। এ শ্রেণির পুঁথির মধ্যে রয়েছে কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া ইত্যাদি। এ শ্রেণির উদাহরণ সত্যপীরের পাঁচালি, গাজীকালু চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, লালমোনের কেচ্ছা প্রভৃতি। ১৩২৮ সালে শেখ ওমরুদ্দিন লিখেন ‘খয়রল হাসর’। মুসলিম জাহানের বিশেষ কাহিনিগুলো একত্রিত করে এ পুঁথি লিখেন তিনি। আদম (.), হাবিলকাবিল, নূহ (.) এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এতে। এ শ্রেণির আরেকটি কাব্য ‘জওরাকল ঈমান। ১৩৩৫ সালে আছগার লিখেন এটা। এর একটি উপদেশ ‘উপকার কর ভাই খোদার বান্দার/তবে তো করিবে খোদা তব উপকার।’ ১৩২৬ সালে মৌলভী আতাউল্লাহ লিখেন ‘হায়রাতুল ফেকা’। এটি ফিকহের বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে সাজানো। এ শ্রেণির আরও কয়েকটি কাব্য হলোমৌলভী ছাজ্জাদ আলীর মোহছেনল ইসলাম, মুন্সী আমানুল্লাহর আহকাম জবে, মুন্সী ফছিহউদ্দীনের ছহি মেছবাহল ইসলাম ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সর্বপ্রথম প্রাচীন ও মধ্যযুগের হারিয়ে যাওয়া বাংলা কাব্য সাহিত্য বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। তিনি প্রাণপাত পরিশ্রম না করলে প্রাচীন সাহিত্যের বহু খ্যাতনামা কবি ও তাদের কীর্তি হারিয়ে যেত চিরতরে। তৎকালীন রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার এক জীবনের শ্রম ও সাধনায় বিপুল সংখ্যক পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আবদুল করিমের সাহিত্যবিশারদ অবদান শুধুমাত্র প্রাচীন পুঁথিপত্র সংরক্ষণের জন্যে নয়, তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯২০২১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সাহিত্যবিশারদ রচিত বাংলা পুঁথির তালিকা বাঙলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ শিরোনামে দুখণ্ডে প্রকাশ করে। তার মধ্যে সংগৃহীত পুঁথির বেশির ভাগ মুসলমান কবিদের লেখা। সাহিত্যবিশারদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে মুসলিম রচিত ৫৯৭ টি বাংলা, ফার্সি ও উর্দু পুঁথি দান করেন। রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে দান করেন ৪৫০ টি হিন্দু পুঁথি যেগুলো তার মৃত্যুর পরে ড. আহমদ শরীফ উক্ত যাদুঘরে প্রদান করেন। তাঁর আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেনপনেরো শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীর, ষোলো শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, সতেরো শতকের কাজী দৌলত, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আঠারো শতকের আলী রজা প্রমুখ। এ ছাড়া ষোলো শতকের দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, গোবিন্দ দাসসহ ত্রিশোর্ধ্ব হিন্দু কবিও রয়েছেন, যাদের পুঁথি ও পদের তিনিই প্রথম আবিষ্কর্তা।

প্রসঙ্গত, সাহিত্যবিশারদ নিজেও অনেক পুঁথির সম্পাদনা করেছেন। অন্তত ১০ টি তো হবেই। যেমন : নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঙ্গ‘, দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্দ, কবি বল্লভের সত্যনারায়ণ পুঁথি, রামরাজার মৃগলুব্ধ সম্বাদ, দ্বিজ মাধবের গঙ্গামঙ্গল‘, আলী রাজার জ্ঞান সাগর, সেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষ বিজয়‘, মুক্তারাম সেনের সারদা মঙ্গল, বাসুদেব ঘোষের শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস, আলাওলের পদ্মাবতীর একাংশ।

এছাড়া, ইসলামাবাদ শিরোনামে তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি গ্রন্থও রচনা করেন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ‘আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ শীর্ষক আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযদি লক্ষ্য ঠিক থাকে
পরবর্তী নিবন্ধপরিবর্তনের ধারায় সমৃদ্ধি অর্জিত হোক