‘পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মতো। কিন্তু আমি তাহার ভিতর যুগযুগান্তরের রক্তধমনী ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধবনি শুনিয়াছি’ –আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
মধ্যযুগীয় পুঁথি অনুসন্ধান করাই শুধু নয়, এর পেছনে তিল তিল সময় দিয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সেই সাধনায় তিনি আজীবন নিজেকে যুক্ত রেখেছেন পুঁথি সাহিত্যের সাথে। তাঁর কথা ছিলো আসলে এখানে তো কোনো ফাঁকিঝুঁকি চলে না। যে সাহিত্যকর্মে ফাঁক আছে সে কখনোই টিকে থাকবে না।
১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর আবদুল করিম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তিন মাস আগে পিতা মুনশি নুরউদ্দীনের বিয়োগ হয়েছে। ৮২ বছরের পূর্ণ জীবন শেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলার সাহিত, গবেষণা, সংস্কৃতি ও সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে আধুনিককালে এক আদিপুরুষ, অতি কীর্তিমান এক বরণীয় ও স্মরণীয় মানুষ। পরিবারদত্ত নাম আবদুল করিম, ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধি চট্টল ধর্মমণ্ডলীর দেওয়া (১৯০৯)। তখন আবদুল করিমের বয়স ৪০ এর নিচে। ততদিনে আবদুল করিমের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ, গবেষণা ও পুঁথিবিষয়ক রচনার জন্য। সে–আমলে বঙ্গীয় মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার পরিস্থিতিতে আবদুল করিমকে উচ্চশিক্ষিতই বলা যাবে। এন্ট্রাস (এখনকার এস এস সি‘র পর্যায়) পাস করে চট্টগ্রাম কলেজ এফএ (উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির সমতুল্য) পড়ার শেষ সময়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা দেননি এবং আর পড়েনওনি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সেখানেই ইতি। তারপরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। চট্টগ্রামের কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। পরে চট্টগ্রামেরই সন্তান বিখ্যাত আমলা মহাকবি নবীনচন্দ্র সেনের স্নেহাকুকুল্যে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের অফিসে কেরানির পদ লাভ করেন। আরও পরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কুল অফিসে সিনিয়র ইন্সপেক্টর কেরানির পদাসিন হয়ে একপর্যায়ে অবসর গ্রহণ করেন। শাহরিক–জীবন আবদুল করিমের পছন্দের বাইরে ছিল। বলতে গেলে, সারাটা জীবন তিনি সুচক্রদণ্ডীর গ্রামীণ পরিবেশেই কাটিয়েছেন এবং সেখান থেকেই সর্ববঙ্গীয় বিদ্বৎমণ্ডলীতে সম্মানিত স্থান অধিকার করে নেন।
জীবনধারণ ও সংসার পরিচালনার জন্য মানুষকে কোনো না কোনো পেশায় বা কর্মে নিয়োজিত থাকতে হয়। সময় সময় সামাজিক মানুষের বাসনায় ও সাড়া দিতে হয়,জনহিতকর কাজে এগিয়ে আসতে হয়। আবদুল করিম স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। কিন্তু এগুলো আবদুল করিমের পরিচয় নয়। তাঁর সুপরিচিতি পুঁথি সংগ্রহ ও সম্পাদনার মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের উপকরণ সঞ্চয়নের জন্য। সঙ্গে পুঁথি ও মধ্যযুগের সাহিত্যবিষয়ক অজস্র লেখালেখি তো আছেই। ‘তিনি পুঁথি সংগ্রহ না করলে এবং পুঁথির বিষয়বস্তু প্রকাশ না করলে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায় অলিখিত থাকতো। সাহিত্যবিশারদ হিন্দু মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের কবিদের রচিত কাব্য সংগ্রহ করেন। তিনি সংগ্রহ না করলে মুসলমানদের রচিত কাব্য সংগৃহীত হতো না।’ (ড.আবদুল করিম)। মূলত এ ভাবনা থেকে সাহিত্যবিশারদ নিজের যাপিত জীবন উজাড় করে হন্যে হয়ে ছুটেছেন প্রাচীন পুঁথিসাহিত্যের দিকে। তৎকালীন রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর এক জীবনের শ্রম ও সাধনায় বিপুল সংখ্যক পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আবদুল করিমের অবদান শুধুমাত্র প্রাচীন পুঁথিপত্র সংরক্ষণের জন্যে নয়, তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্ধকারকে হারিয়ে যে আলো জ্বালিয়েছেন তা কাল থেকে কালান্তরে বহমান থাকবে।
প্রসঙ্গত, ঐ সময়কালে অনেকের ঘরে পুঁথি তখনো সযত্নে রক্ষিত ছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে যায়নি। আবদুল করিম কঠোর পরিশ্রম, অসীম ধৈর্য ও নানান কায়দায় তা সংগ্রহ করেন। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই নিজের উৎসাহ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি এ–কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গীয় পুঁথি সংগ্রাহকদের প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য ছিল, কিন্তু আবদুল করিমের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। তিনি একাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে, খোঁজখবর নিয়ে অসংখ্য পুঁথি সংগ্রহ করেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন একখানি পুঁথির জন্য। পেলে অপরিসীম আনন্দ পেতেন, এত পরিশ্রমের সার্থকতা অনুভব করতেন এবং পুঁথিগুলো কাগজে মুড়ে সযত্নে সংরক্ষণ করতেন।
উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে রচিত পুঁথি সাহিত্যের ভাণ্ডার ছিল যে কোনো সাহিত্যের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সাহিত্যবিশারদ এক ভাষেেণ বলেন ‘আমি যে কালে সাহিত্যে প্রবেশ করি, তখন দ্বিতীয় মুসলমান কেহ ছিল না বলিলেই হয়। হিন্দু পুস্তক, পত্রিকা পাঠ করিতে করিতে একটা প্রশ্ন আমার মনে আন্দোলিত হইতো যে, আধুনিক কালের মতো প্রাচীন কালেও কি মুসলমান ছিল না? প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করিতে বুঝিতে পারি যে হিন্দুর মতো মুসলমানেরও একটা বিরাট সুগঠিত ও উন্নত প্রাচীন সাহিত্য আছে। তাহাই প্রমাণ ও প্রদর্শন করিবার জন্য নিজের দারিদ্র ও ক্ষুদ্র শক্তি বিস্তৃত হইয়া আমি ধ্যানমগ্ন যোগীর ন্যায় বিগত অর্ধ শতাব্দী কাল এক ধ্যানে কাটাইয়া আজ ৭৪ বৎসর বয়সে উপনীত হইয়াছি।’ (১৯৪৫ এ জয়ন্তী উৎসবে মানপত্রের উত্তরে ভাষণ)
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। সারা জীবন তিনি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি (পুঁথি) সংগ্রহ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদত্ত পুঁথিগুলোর বিবরণ আবদুল করিমের ভাইপো, দত্তক পুত্রক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক আহমদ শরীফের সম্পাদনায় “পুঁথি পরিচিতি”নামে প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা বিভাগেরও প্রথম প্রকাশনা। এছাড়া বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশিত পুস্তক “লায়লী–মজনু” আহমদ শরীফ সম্পাদিত এবং তা আবদুল করিমেরই আবিষ্কার।
১৯২০–২১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁর রচিত বাংলা পুঁথির তালিকা বাঙলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ শিরোনামে দুখণ্ডে প্রকাশ করে। তার মধ্যে সংগৃহীত পুঁথির বেশিরভাগ মুসলমান কবিদের লেখা। সাহিত্যবিশারদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে মুসলিম রচিত ৫৯৭ টি বাংলা, ফার্সি ও উর্দু পুঁথি দান করেন। রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে দান করেন ৪৫০ টি হিন্দু পুঁথি যেগুলো তাঁর মৃত্যুর পরে আহমদ শরীফ উক্ত যাদুঘরে প্রদান করেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রাণপাত পরিশ্রম না করলে প্রাচীন সাহিত্যের বহু খ্যাতনামা কবি ও তাঁদের কীর্তি হারিয়ে যেত চিরতরে । তাঁর আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেন–পনেরো শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীর, ষোলো শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, সতেরো শতকের কাজী দৌলত, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আঠারো শতকের আলী রজা প্রমুখ। এ ছাড়া ষোলো শতকের দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, গোবিন্দ দাসসহ ত্রিশোর্ধ্ব হিন্দু কবিও রয়েছেন, যাদের পুঁথি ও পদের তিনিই প্রথম আবিষ্কর্তা।
বলাবাহুল্য, সাহিত্যবিশারদ নিজেও অনেক পুঁথির সম্পাদনা করেছেন। অন্তত ১০ টি তো হবেই। যেমন: নরোত্তম ঠাকুরের “রাধিকার মানভঙ্গ”, দ্বিজ রতিদেবের “মৃগলুব্দ”, কবি বল্লভের “সত্যনারায়ণ পুঁথি”, রামরাজার “মৃগলুব্ধ সম্বাদ”, দ্বিজ মাধবের “গঙ্গামঙ্গল”, আলী রাজার জ্ঞান সাগর, সেখ ফয়জুল্লাহর “গোরক্ষ বিজয়”, মুক্তারাম সেনের “সারদা মঙ্গল”, বাসুদেব ঘোষের “শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস”, আলাওলের “পদ্মাবতীর একাংশ”।
পুঁথি সম্পাদনায় আবদুল করিমের পারঙ্গমতা প্রশ্নাতীত। এ নিয়ে তাঁকে কত যে পরিশ্রম করতে হয়েছে হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।“রাধিকার মানভঙ্গ” পুঁথির সম্পাদনার এবং গুণপনা ও পারিপাট্য দেখে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবদুল করিমকে জার্মান এডিটরের সমতুল্য জ্ঞান করেছেন।
এছাড়া ইসলামাবাদ শিরোনামে তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি গ্রন্থও রচনা করেন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ‘আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ শীর্ষক আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। পুঁথি সম্পাদনা ছাড়াও আবদুল করিমের রয়েছে অজস্র প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনা, সমালোচনা, পরিচিতি ইত্যাদি মূল্যবান রচনা। তাঁর অভিভাষণগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান।
জীবনসায়াহ্নে জ্ঞানগর্ভ একটা অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন, “আজ আমি জীবনসায়াহ্নে দাঁড়াইয়া আমার মন ও কণ্ঠের সমস্ত জোড় দিয়া, আপনাদের তথা সমগ্র দেশের সামনে অসংকোচে এই কথা বলিতে চাহি যে, পুঁথি সাহিত্য আবর্জনা নহে, উপেক্ষার বস্তু নহে, সাহিত্যের দরবারে মূল্যহীন তুচ্ছ জিনিস নহে।”
সর্ববঙ্গীয় পণ্ডিতজন ও ইতিহাসপ্রণেতারা আবদুল করিমের কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের প্রাচীন লুকায়িত সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে বিশ্ব দরবারে। কালোত্তীর্ণ এই জ্ঞানসাধক গোটা দেশ ও জাতিকে করেছে গৌরবান্বিত।
তথ্যসূত্র
১। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ – আহমদ শরীফ
২। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ:জীবন ও কর্ম –ড. আবদুল করিম
৩।আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ :ঐতিহ্য অন্বেষার প্রাজ্ঞ পুরুষ –আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত
৪।আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণ সমগ্র–ইসরাইল খান।
৫।দীপ্ত আলোর বন্যা–আজহার উদ্দিন খান।
nooruddin.cu@gmail.com