পুঁজিবাদের অন্ধকার দিকগুলো ও ইসলামী ভার্সনের উত্থান

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৪ at ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদ একটি প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত মুনাফা ও সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি দিলেও এর অনেক অন্ধকার দিক রয়েছে। বিশেষ করে, এই ব্যবস্থা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার এবং নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়। ইসলামের নৈতিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুঁজিবাদের এসব দিককে চরমভাবে নিন্দা করা হয়েছে। তবে, অনেক ইসলামী পুঁজিপতি বা ব্যবসায়ী ‘পুঁজিবাদের’ এই অন্ধকার দিকগুলো উপেক্ষা করে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সমৃদ্ধির আশায় কুরআনের কিছু দোয়া এবং আয়াতকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

পুঁজিবাদ ও দোয়া ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান্নার’ ইসলামিক পুঁজিপতিরা অনেক সময় দোয়া ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতান ওয়া ক্বিনা আযাবান্নার’ (সূরা বাকারা, ২০১) নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেন। এর সাধারণ অর্থ হল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও, আখিরাতেও কল্যাণ দাও, এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’

অনেকে এই দোয়াকে কেবলমাত্র দুনিয়ার সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদ অর্জনের দোয়া হিসেবে দেখেন এবং পুঁজিবাদী চেতনা দিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেন। কিন্তু এই আয়াতের প্রকৃত অর্থ হলো, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। দুনিয়ার হাসানাতবলতে কেবলমাত্র ধনসম্পদের সঞ্চয় নয়, বরং নৈতিক, সামাজিক, এবং আত্মিক উন্নতিও বোঝানো হয়েছে। ইসলাম যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চায়, তা হলো সকলের জন্য সুবিচার এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু ইসলামী পুঁজিপতিরা প্রায়শই তাদের স্বার্থপর ও মুনাফামুখী আচরণকে এই দোয়ার মাধ্যমে সঠিক বলে দাবি করেন, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বিপরীত।

পুঁজিবাদের অন্ধকার দিকগুলো :

. সম্পদের অসম বণ্টন

পুঁজিবাদের মুনাফানির্ভর নীতির কারণে অর্থ, সমাজের একটি ছোট অংশের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। মুসলিম ব্যবসায়ীরা প্রায়ই নিজেদের সম্পদ অর্জনকে ইসলামিক নৈতিকতার আলোকে বৈধ মনে করেন, কিন্তু তারা যাকাত এবং সদকা দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্রদের প্রতি তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যান। ইসলাম শুধুমাত্র সম্পদ অর্জনের অনুমতি দেয় না, বরং সেই সম্পদের সঠিক বণ্টনকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। সম্পদের এই অসম বণ্টনের কারণে বৈষম্য তৈরি হয়, যা ইসলামের ন্যায়পরায়ণতার মূল নীতির পরিপন্থী।

. ভোগবাদ ও নৈতিক অবক্ষয়

পুঁজিবাদের প্রভাবিত বিশ্বে ভোগবাদ মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। মানুষ মুনাফার পেছনে ছুটে নিজের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। অনেক মুসলিম ব্যবসায়ী এই ভোগবাদী চিন্তাধারায় নিজেদের সাফল্যকে ইসলামের আশীর্বাদ হিসেবে ভুলভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু ইসলাম শিক্ষা দেয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, এবং নৈতিকতার চর্চা করতে, যা পুঁজিবাদের ভোগবাদী চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

. নৈতিকতার অভাব

পুঁজিবাদে মুনাফার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া হয়, যার ফলে অনেক ব্যবসায়ী নৈতিকতার সাথে আপস করে। শ্রমিকদের শোষণ, কর ফাঁকি, এবং পরিবেশ দূষণের মত বিষয়গুলো পুঁজিবাদী ব্যবসার সাথে জড়িত। ইসলামে ব্যবসায়িক নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ন্যায়বিচার, সততা, এবং দায়িত্বশীলতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ইসলামী বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

ইসলামের অর্থনৈতিক নীতি সম্পদের সঠিক বণ্টন, সুদমুক্ত অর্থনীতি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি পুঁজিবাদী শোষণমূলক চেতনার বিপরীত।

. সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন

ইসলাম যাকাত এবং সদকা প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। এটি সম্পদশালীদের উপর দরিদ্রদের অধিকার সুরক্ষিত করে। যাকাত একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব, যা পুঁজিবাদী মুনাফার চেতনার বিপরীতে সমাজের সকলের জন্য কল্যাণ নিশ্চিত করে।

. সুদমুক্ত অর্থনীতি

ইসলামী অর্থব্যবস্থার একটি মৌলিক নীতি হলো সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ করা। সুদ সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ সৃষ্টি করে, যা পুঁজিবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

. নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

ইসলামী অর্থনীতি মুনাফার পাশাপাশি নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও গুরুত্ব দেয়। একজন ব্যবসায়ীকে কেবল তার ব্যক্তিগত মুনাফা নয়, বরং সমাজের কল্যাণ এবং নৈতিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ।

দারিদ্র্য বিমোচন উদ্যোগ: মুসলিম দেশগুলোতে যাকাত ব্যবস্থা সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে সমাজে পুঁজিবাদী বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। পুঁজিবাদের অন্ধকার দিকগুলো যেমন সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, নৈতিক অবক্ষয়, এবং সামাজিক অবিচার ইসলামের অর্থনৈতিক নীতির পরিপন্থী। ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নৈতিকতা, আত্মিক উন্নয়ন, এবং সমাজের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জিত হয়। পুঁজিবাদের পরিবর্তে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেমন যাকাত, সুদমুক্ত ব্যাংকিং, এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা, সমাজের জন্য ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাধান প্রদান করে, যা প্রকৃতপক্ষে দোয়া ‘রাব্বানা আতিনা’ এর সঠিক ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতান ওয়া ক্বিনা আযাবান্নার’ দোয়াটি সাহাবিদের (রাঃ) যুগে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেত, কারণ তারা এই দোয়ার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করতেন। সাহাবি এবং খলিফাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই দোয়া শুধুমাত্র দুনিয়ার সম্পদ বা ধনসম্পদ অর্জনের জন্য নয়, বরং দুনিয়াতে নৈতিক, আত্মিক এবং সামাজিক কল্যাণ এবং আখিরাতে মুক্তি লাভের জন্য পাঠ করা হতো।

সাহাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি:

সাহাবিরা দুনিয়ার সুখস্বাচ্ছন্দ্য কামনা করতেন ঠিকই, তবে তা কখনও সীমাহীন ধনসম্পদ বা ভোগবাদের জন্য ছিল না। বরং তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন যেন তাদের দুনিয়ার জীবন এমন হয়, যা তাদের আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক হয় এবং আখিরাতে জান্নাত লাভের পথ সুগম করে। উদাহরণস্বরূপ, সাহাবি আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এই দোয়া পাঠ করতেন, এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার জন্য প্রার্থনা করতেন।

খলিফাদের দৃষ্টিভঙ্গি:

প্রথম চার খলিফা হজরত আবু বকর (রাঃ), উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ), উসমান ইবনে আফফান (রাঃ), এবং আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) এই দোয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভালোভাবে বুঝতেন এবং মুসলিম সমাজে এর যথাযথ প্রয়োগ করতেন। তারা দুনিয়ার কল্যাণ বলতে ন্যায়, সৎ জীবনযাপন, এবং আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যবহার করাকে বোঝাতেন। দুনিয়ার সম্পদকে তারা আল্লাহর এক পরীক্ষার অংশ মনে করতেন এবং তাই আল্লাহর দেয়া সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার উপর গুরুত্ব দিতেন।

হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর এক বিখ্যাত বাণী রয়েছে: ‘আমাদের জন্য দুনিয়ার কল্যাণ হলো যথেষ্ট সম্পদ, যা দিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পারি এবং আখিরাতের কল্যাণ হলো জান্নাত, যেখানে আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করব।”

দুনিয়ার সম্পদ এবং এই দোয়ার মূল শিক্ষা:

ইসলামে দুনিয়ার সম্পদকে শুধুমাত্র আল্লাহর পথে ব্যয় করার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। সাহাবি এবং খলিফারা এটাকে কখনও সীমাহীন ধনসম্পদের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে নেননি। বরং তারা দুনিয়ার জীবনের সকল কল্যাণ ও সুখকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং আখিরাতের সফলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতেন।

সুতরাং, এই দোয়ার উদ্দেশ্য কখনই সীমাহীন ধনসম্পদ অর্জন নয়, বরং দুনিয়ার সব ধরনের কল্যাণ কামনা করা যাতে তা আল্লাহর পথে ব্যবহার করা যায় এবং আখিরাতে মুক্তি লাভ করা যায়।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস, এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রীজ লিঃ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফিবাদের পথ প্রদর্শন ও বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানীর (রা.) জীবনদর্শন
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর