আমাদের দেশে নারীরা এখনও মাসিক বা পিরিয়ডকে একটি লজ্জার ব্যাপার বলে মনে করে। পরিবারের বড়রাও মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অথচ একজন নারীর জীবনে এ অধ্যায়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নারীর পূর্ণতা লাভের সুসংবাদ।
অধুনা বিশ্বে ২৮ মে বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে নারীরা যেসব কারণে মৃত্যুবরণ করেন, তার মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে শুধুমাত্র পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করার কারণ ।
সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রসর হলেও বাংলাদেশে ৮৩ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। মাসিকের সময় অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করার কারণে তারা সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়েন।
অসচেতনতার কারণে পিরিয়ড হলে অনেক কিশোরীই ভয় পেয়ে লজ্জায় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে দুশ্চিন্তা করে। যা তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সমস্যা করতে পারে। ১১/১২ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য পিরিয়ডের প্রথম অভিজ্ঞতা হয়, ভয়াবহ ও বিব্রতকর।
মেয়ে সন্তানের জন্য পিরিয়ড সম্পর্কে জানাও একটা বয়সের পর মোটামুটি প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। তাই পিরিয়ডের মতো জরুরি বিষয় নিয়ে লজ্জা না রেখে সন্তানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। সন্তান বয়ঃসন্ধিতে এলেই এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করুন। শারীরিক পরিবর্তন, পিরিয়ড কেন হয়, সেই বিষয়ে বৈজ্ঞানিকভাবেই স্পষ্ট ধারণা দিন সন্তানকে।তাঁর লজ্জা কাটিয়ে তাকে সচেতন করে তুলুন। টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখে ছোট শিশুটিও যদি জানতে চায়, তাকে এটা–ওটা না বলে, খুব সাধারণভাবে বুঝিয়ে বলুন।
এতে করে নারীর প্রতি সম্মান নিয়ে বেড়ে উঠবে, খামোখা অতি আগ্রহ দেখাবে না। বাড়িতে আলোচনা করা উচিত মাসিক নিয়ে। পিরিয়ড কোনো অসুখ না, এটা নারী জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সন্তানের পিরিয়ড হলে তার স্বাস্থ্যকর, পরিষ্কার থাকার বিষয়ে লক্ষ্য রাখুন। ইনফেকশন এড়াতে এসময়ে কাপড়, তুলা, টিস্যু নয় ব্যবহার করতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন। কেমিক্যালযুক্ত সুগন্ধি প্যাড ব্যবহার করলে সংক্রমের ঝুঁকি বাড়বে।
পিরিয়ড আর পাঁচটা স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার মতোই একটি প্রক্রিয়া। তবুও ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ঘিরে এখনো এই সমাজে নানা কুসংস্কার রয়ে গেছে। একজন নারীর পিরিয়ড হলেই তাকে এ সমাজ অশুচির তকমা দিয়ে থাকে। এ সমাজে এমন সংস্কৃতি বহুকাল থেকেই চলমান। এ সমাজের একটা বড় অংশ এখনও মনে করেন, একজন মেয়ের ‘ঋতুস্রাব’ হওয়া মানে সে অশুচি, অ–পবিত্র! যার ফলে ‘ঋতুস্রাব’ চলাকালীন মেয়েরা রান্না করতে পারেন না, মন্দিরে যেতে পারেন না, পবিত্র কোনো স্থানে যাওয়া বারণ। এসময়ে হাত দিয়ে আচার খেলে তা খারাপ হয়ে যাবে, এছাড়া আরও অনেক কুসংস্কার প্রথা চালু আছে এই ‘ঋতুস্রাব’ নিয়ে। এখনও বহু নারী বাজারে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে লজ্জা পান। দোকানিও ন্যাপকিন এমনভাবে কাগজে মুড়ে দেন, যেন এগুলো অবৈধ কোনো কিছু। যেন, কত গোপন একটা ব্যাপার। স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করার সময় একজন দোকানদার এতোটা রাখঢাক করেন আর মেয়েটিই এতোটা ইতস্তত করেন, যেন মাসিক হওয়া খারাপ। অথচ একজন মেয়ের ‘ঋতুস্রাব’ শুরু হওয়া মানে, ওই মেয়ে আরেকটি প্রাণের জন্ম দিতে পারার শক্তি সঞ্চার করা। নিয়মিত ‘ঋতুস্রাব’ হওয়া মানে অনেক রোগ–প্রতিরোধ করা।
পাঠ্যপুস্তকে মাসিক নিয়ে অধ্যায় থাকলেও ক্লাসে তা পড়ানো হয় না। আমাদের সময়েও দেখেছি শিক্ষক বলতেন, ‘এই অধ্যায়টা বাসায় পড়ে নিও।’ এটা খুবই দুঃখজনক। সবচেয়ে জরুরি যেসব স্কুলে মেয়েরাও পড়ে সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা । গ্রামেগঞ্জের স্কুলগুলোতে এই বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করতে হবে। স্কুলে ভালো শৌচাগার থাকে না। প্যাড পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না। এই সময়ে মেয়েরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।
স্যানিটারি প্যাডের দাম কমাতে হবে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করলে শ্রমজীবী মানুষের কেনার সামর্থ্য হবে। অনেকে অর্থসংকটের কারণে সুরক্ষা প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, সংক্রমণ থেকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। অনেকে প্যাডের খরচ বাঁচানোর জন্য প্যাডের উপর টিস্যু ব্যবহার করেন, সেটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
ঋতুস্রাব নিয়ে এসব কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রতিটি মেয়েরই লড়াই করা উচিত। ‘ঋতুস্রাব’ চলাকালীন যাতে কোনো মেয়ে লজ্জা না পায়, লজ্জা ভেঙে যাতে সে বাইরে আসতে পারে, সে জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
জাগো নারী জাগো, সময় এসেছে, জাগো এবার জাগো। লজ্জা নয়, গর্ব করেই বলো, অসুখ নয়, আমার মাসিক চলছে।