পিতা-মাতার আশ্রয় হোক সন্তানের বুকে, বৃদ্ধাশ্রমে নয়

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | সোমবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

এ বিশ্বে প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই সেরা। ইসলাম ধর্ম মতে মহান আল্লাহর সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। তিনি তাঁর এ সৃষ্টিকে বলেছেন ‘আশরাফুল মাখলুতাত’। অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পিতামাতার অপরিমেয় স্নেহ যত্ন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে জন্ম জাত সন্তান বড় হয়ে উঠে। সন্তানের জীবন গঠনে মাতা পিতার অবদান অপরিসীম। পিতামাতা শিক্ষিত অশিক্ষিত যে অবস্থানে থাকুক না কেন সন্তানের কাছে তাঁদের পরিচয় তাঁরা মাতাপিতা। কাজেই পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কর্তব্যেরও শেষ নেই। পাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিন বলেছেন ‘পৃথিবীতে তিনটি কর্তব্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সৃষ্টি কর্তার প্রতি কর্তব্য, মাতা পিতার প্রতি কর্তব্য এবং মানব জাতির প্রতি কর্তব্য ’।

মাতাপিতা সন্তানের মাথার উপরে ছায়া দানকারী ছাতা সদৃশ। যারা পৃথিবীতে সন্তানের প্রতি সর্বাধিক স্নেহ, মমতা অনুগ্রহ প্রদানকারী ব্যক্তিরা হচ্ছেন মাতাপিতা। শ্রীমদ্ভগবদ্‌ গীতায় বর্ণিত আছে -‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতা হি পরমং তপ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্ব দবতা’। অর্থাৎ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। গীতায় এও বলা আছে– ‘যত্‌ প্রসাদং পূর্ণকামোয়দাশিষা প্রতক্ষ দেবতায়ৈ মে তস্যে মাত্রে নমো নম’। অর্থাৎ যার অনুগ্রহে আমি এ জগৎ দেখতে পেয়েছি, যাঁর আশীর্বাদে আমার কামনা পূর্ণ হয়েছে, আমার প্রত্যক্ষ দেবতা সেই জননীকে বারবার প্রণাম করি। মাতাপিতাই সন্তানের সর্বাপেক্ষা আপনজন। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহতালা বলেছেন ‘মাতাপিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর। তোমার জীবদ্দশায় তাঁরা যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাঁদের উদ্দেশ্যে সামান্য অবহেলা প্রদর্শন করবে না। তাঁদের ধমক দিও না বরং তাঁদের সাথে মার্জিত ভাষায় কথা বলবে। তাঁদের প্রতি বিনয়ী হয়ে উভয়ের সেবাযত্ন করবে, যেমন সেবাযত্নে শৈশবে তাঁরা তোমাকে প্রতি পালন করেছেন। ‘-(বনী ইসরাঈল ২৩২৪)। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন’ পিতামাতা হলো জান্নাত এবং জাহান্নাম অর্থাৎ তুমি ইচ্ছে করলে তাঁদের সেবাযত্ন করে উত্তম আচরণের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারো, আবার বিপরীতভাবে তাঁদের অবাধ্য হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারো’। ধর্মীয় অনুশাসনের দিক থেকে পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য যেমন রয়েছে অভিসম্পাত, তেমনি তাঁদের আনুগত্যের জন্য রয়েছে পুরস্কার। পবিত্র বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। খৃষ্ট ধর্মেও মাতা পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের বিশদ উল্লেখ রয়েছে। মহামানব গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনে মাতা পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যাদির যথেষ্ট উপদেশ রয়েছে। মাতাপিতা সন্তানের আদিগুরু, শিক্ষায় হাতেখড়ি দাতা। শিশু সন্তানকে সর্ববিষয়ে প্রারম্ভিক শিক্ষা প্রদানে মাতা পিতার কোনো বিকল্প নেই। পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে ১০ মাস গর্ভধারণ শেষে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাদের জন্য অক্লান্ত, পরিশ্রম, সেবা যত্নের মাধ্যমে তাদের লালন পালন করে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে মাবাবার ত্যাগ তিতিক্ষা অতুলনীয়। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে আজকাল দেখা যায় যে পিতামাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে অনেক সন্তান/পুত্রবধূরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের মাধ্যমে পিতামাতার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। অনেকে আবার শারীরিক নির্যাতনও করে থাকে। পিতামাতাকে হয়তো স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় নতুবা সন্তান পুত্রবধূর নির্যাতনে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। অথচ তারা একবারও ভেবে দেখে না যে তাদের সন্তানদের নিয়ে অট্টালিকা সদৃশ সুরম্য গৃহে কত সুখেই না তারা জীবন অতিবাহিত করে চলেছে। এসব অকৃতজ্ঞ সন্তানরা ভাবে না তাদের ঔরসজাত সন্তানের হাতে অনুরূপভাবে তাদেরকেও হয়তো এ ধরনের দুরদৃষ্টের শিকারে পরিনত হতে হবে। দেশের নামকরা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক প্রফেসরের তিনজন পুত্র ও কন্যা সন্তান উচ্চ শিক্ষিত এবং দেশ বিদেশে যোগ্যতম কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। ছেলের স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে নাকি তাকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে তাঁর বসতবাড়িও নাকি আত্মসাৎ করে এসব সুসন্তাদের কোনো একজন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো প্রফেসর মহোদয়ের চাকরি জীবনের শেষ সম্বল গ্র্যাচুয়িটির বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে ছোট ছেলে ভাগ্যান্বেষণে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল। সম্ভবত ছেলেটি এখন প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত জীবন যাপন করছে। সেই ছেলে নাকি দেশে এসে বাবাকে মিরপুরের একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে তার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করে। জন্মদাতা পিতা ছেলের বৌ দেখতে চাইলে ছেলে নাকি দেখাতে রাজি হয়নি। কীসের হীনম্মন্যতায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন প্রফেসরকে ছেলের বৌয়ের মুখদর্শন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল? ভাবতেও অবাক লাগে পিতৃঋণ অস্বীকার করা এসব কৃতঘ্ন সন্তানদের আচরণ দেখে। আমার আর একজন পরিচিত ভদ্রলোক উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ১ম স্ত্রীও ছিলেন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ১ম স্ত্রীর একমাত্র পুত্রসন্তান জন্মের কয়েক বছর পর ভদ্রলোক ১ম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে ২য় স্ত্রীকে ঘরে তোলেন। ডিভোর্স প্রাপ্ত ১ম স্ত্রী সরকারি চাকরির পাশাপাশি প্রাণপণ চেষ্টায় একমাত্র পুত্রসন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। এমনকি সন্তানকে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রি লাভের সুযোগ করে দেন। বাবামার পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করানো হয়। তারা উভয়ে এখন প্রবাসে কর্মরত। অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত পরিবারের চেয়ে শিক্ষিত পরিবারেই বোধহয় এ ধরনের জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা বেশি দৃশ্যমান। সেইসব সন্তানদের লেখাপড়া ও মানুষ করার লক্ষ্যে মাবাবার নির্ঘুম প্রচেষ্টা ও ত্যাগ মুহূর্তেই মূল্যহীন ও ম্লান হয়ে যায় এ ধরনের অদৃশ্য ও অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপ আর ষড়যন্ত্রের কারণে। আমার পরিচিত অন্য এক ভদ্রলোক দেশে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও সোনার হরিণ ধরার লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। অর্থ, বিত্ত প্রাচুর্যের বিনিময়ে তিন সন্তানকে বিদেশের নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে মাবাবা দেশে ফিরে বসবাস করতে থাকলেও তাঁদের মনের শান্তি যেন চিরকালের জন্য নির্বাসনে চলে যায়। মহৎ ত্যাগ ও পরিশ্রমের বিনিময়ে সন্তানদের মানুষ করার যে স্বপ্নে পিতামাতা বিভোর ছিলেন, তাদেরই সুসন্তানরা পিতামাতার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজে পাচ্ছে না। মৃত্যুর আগে শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে উনার কোন এক আত্মীয় তাঁর বাসায় বেড়াতে আসলে তিনি নাকি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনার ছেলেরা তো বিদেশে, তারা কি আপনার খোঁজ খবর নেয় এবং আপনাকে দেখতে আসে? ভদ্রলোক ইতিবাচক উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার সন্তানরা আমাকে দেখতে আসে’। তখন শয্যাশায়ী ভদ্রলোক বলেন, ‘অনেক দিন প্রবাস জীবনে ছিলাম, সন্তানদের বিদেশের মাটিতে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।

সারাজীবন আমার হিসেবের অঙ্কে ভুল করে ফেলেছিলাম। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছি কিন্তু মানুষতো করতে পারিনি। ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তাদের লেখাপড়া না শিখিয়ে কুকুর পুষলে হয়তো ভালো হতো। কুকুর প্রভুভক্ত, ইতর প্রাণী হলেও তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ আছে। কাজেই মাতা পিতার রক্তের ঋণ, অসীম ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের কথা শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরণে রেখে এসব কৃতজ্ঞ সন্তানদের মনে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা বোধ জেগে উঠুক তাদের মনে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, কৃতজ্ঞতা বোধ, মনুষ্যত্ব বোধে উদীপ্ত হোক তাদের অন্তর, বিক্ষুব্ধ পিতামাতার পূর্ব প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রতিটি মাবাবার সন্তানেরা সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। যে মাবাবারা তাঁদের শুদ্ধ চিন্তা চেতনায় সর্বস্ব ত্যাগ করে নিজ সন্তানদের মানুষ করার পেছনে অর্থ বিত্ত, শ্রম বিসর্জন দিয়ে থকেন, তাঁদের জীবনে এসব নেতিবাচক ধারণা ঘটুক তা বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যৎ সন্তানেরা গভীর ভাবে অনুধাবন করুক এবং গভীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সততা, কৃতজ্ঞতা ও মনুষ্যত্ব বোধে উদীপ্ত হয়ে জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাত্রী মাতার ঋণ পরিশোধে দৃঢ় প্রত্যয়ী হোক। মাবাবার সুমহান মর্যাদা সযত্নে প্রতিষ্ঠিত হোক পরিবাবে,সমাজে ও মানবতার ইতিহাসে। মাবাবার নিঃশ্বাস যাতে যন্ত্রণার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে পরিণত না হয়। সন্তান এবং পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের স্নেহ, মমতা ও নাড়ীর বন্ধন হোক অসহায় বৃদ্ধ পিতামাতার ক্ষুদিত অন্তরে শান্তির বাতাবরণ আনন্দ সুখের অনির্বচনীয় সান্ত্বনা। মাবাবার আশ্রয় হোক সন্তানের বুকে, বৃদ্ধাশ্রমে নয়তাই হোক সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঋত্বিক ঘটক : মননশীলতায় ঋদ্ধ চলচ্চিত্রকার
পরবর্তী নিবন্ধমুজিব বাহিনীর পরিচালন ও প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে