চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রায় সাড়ে ৮ লাখ গ্রাহক রয়েছেন। তম্মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ গ্রাহক প্রি-পেইড মিটার পেয়েছেন। তবে বাকি ৪ লাখ গ্রাহক গত দুই বছর ধরে প্রি-পেইড মিটারের জন্য অপেক্ষা করলেও তা মিলছে না। এছাড়া পুরনো মিটারগুলোতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তারও সমাধান মিলছে না । ভুতুড়ে বিল, গড় বিলসহ নানা ভোগান্তি এড়াতে গ্রাহকরা যখন প্রি পেইড মিটারের দিকে ঝুঁকছেন তখন এ সংকট নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, পিডিবির সরবরাহ দেওয়া মিটারের চেয়ে বাজার থেকে খরিদ করা মিটারের মূল্য দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি। তাই বেসরকারি বিপণনকারীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য পিডিবি নতুন করে কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছে না।
পিডিবি নিউমুরিং বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের গ্রাহক মধ্যম হালিশহর এলাকার সাঁচী চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা মো. আলী বলেন, ‘আমাদের প্রতিমাসে ২৫০ থেকে ৩২০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। মিটারে গত নভেম্বর মাসের সর্বশেষ ক্রমযোজিত রিডিং ছিল ১৮৭০০ ইউনিট। গত ১২ জানুয়ারি সকালে হঠাৎ দেখি মিটারের রিডিং জাম্প করে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৩৬ ইউনিট হয়ে গেছে। মিটারের ত্রুটি সারানোর জন্য আমরা লিখিত আবেদন করেছি। পাশাপাশি নতুন প্রি-পেইড মিটারের জন্যেও আবেদন করেছি। কিন্তু জানতে পেরেছি পিডিবিতে কোনো প্রি-পেইড মিটার নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘হালিশহর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে বিদ্যুতের নানা জটিলতা রয়েছে। সরকারিভাবে প্রি-পেইড মিটার সংযোজন করা গেলে বিদ্যুৎ চুরিসহ বকেয়া বিলের ঝামেলাও মিটত।’
নগরীর বাকলিয়া ডিসি রোড এলাকার বাসিন্দা জিয়াউল হাসান বলেন, ‘আমার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বাবার নামেই বিদ্যুতের মিটার ছিল। প্রকল্প থেকে প্রি-পেইড মিটার দেওয়া হলেও এখন অস্বাভাবিকভাবে বিল কাটা হচ্ছে। কোনো কোনো দিন এক হাজার টাকা রিচার্জ করলেই পরের দিন সকালে বিদ্যুৎ থাকছে না। বাকলিয়া বিতরণ বিভাগের অভিযোগ দেওয়ার পর, তারা রিডিং স্লাব জটিলতার অযুহাত তুলছেন। এখন আমরা আলাদা প্রি-পেইড মিটারের আবেদন করেছি। তিন চার মাস হয়েছে এখনো মিটার পাওয়া যাচ্ছে না।’
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চল পিডিবিতে বর্তমানে ১১ লাখ ৭৮ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। তন্মধ্যে রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে ১ লাখ ৪০ হাজার, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার গ্রাহক। মহানগরীতে রয়েছে ৮ লাখ ৩১ হাজার গ্রাহক। চট্টগ্রামের গ্রাহকদের প্রি পেইড মিটার সংযোজনের জন্য ২০১৬ সালে চীনা প্রতিষ্ঠান মেসার্স হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের সাথে ‘প্রি পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ফর ডিস্ট্রিবিউশন সাউদার্ন জোন’ শীর্ষক প্রকল্পের চুক্তি করে পিডিবি। প্রথম পর্যায়ের ওই প্রকল্পে ১ লাখ ৩৯ হাজার, দ্বিতীয় পর্যায়ে দেড় লাখ গ্রাহককে প্রি-পেমেন্ট মিটারিংয়ের আওতায় আনা হয়। একই সময়ে বৃহত্তর রংপুর-রাজশাহী অঞ্চলের জন্য নেওয়া প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রকল্প হতে এক লাখ মিটারও নগরীতে সংযোজন করা হয়। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার লাখ প্রিপেইড মিটার সংযোজন করে পিডিবি।
পিডিবি নিউমুরিং বিক্রয় বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নিউমুরিং বিতরণ বিভাগের আওতায় প্রায় ৪৬ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। তন্মধ্যে ২৯ হাজার গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার রয়েছে। অন্য ১৭ হাজার গ্রাহককে এখনো প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রাহকরা বাজার থেকে মিটার সংগ্রহ করে দিলে আমরা সংযোজন করে দিই।’ তিনি বলেন, ‘পিডিবির প্রি পেইড মিটার প্রজেক্ট অনেক আগে শেষ হয়েছে। আবার পিডিবি থেকে কিছু মিটার সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল। এখন তাও বন্ধ। যে কারণে গ্রাহকরা চাইলেই পিডিবি থেকে মিটার সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া এখানকার কিছু গ্রাহকের বিদ্যুৎ চুরির অভ্যাস রয়েছে। তারা সার্ভিস লাইন বাইপাস, হুকিং করে বিদ্যুৎ চুরি করে।’
অন্যদিকে কালুরঘাট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গিয়াস ইবনে আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কালুরঘাট বিতরণ বিভাগের অধীনে প্রায় ৭০ হাজারের মতো গ্রাহক রয়েছেন। যার মধ্যে ৫৫ হাজার গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা হয়েছে। সব গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা গেলে বিদ্যুৎ চুরি ও সিস্টেম লস অনেকাংশে কমে যাবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘নগরীর সব গ্রাহকই আর্থিকভাবে সামর্থবান নয়। দরিদ্র ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল গ্রাহকদের একসাথে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বাজার থেকে প্রি-পেইড মিটার কেনার সামর্থ্য নেই। পিডিবি থেকে সরবরাহ দেওয়া হলে দরিদ্র গ্রাহকদেরও প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’ বাজারের সাথে পিডিবির সরবরাহকৃত মিটারের দামের তফাতের বিষয়টি স্বীকার করে এ প্রকৌশলী বলেন, ‘বাজারে ৫ হাজার তিনশ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামে প্রি-পেইড মিটার পাওয়া যায়। কিন্তু পিডিবির সরবরাহকৃত মিটারের দাম পড়ে আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।’
পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার সামছুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিদ্যুতের প্রায় সাড়ে চার লাখ গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রি-পেইড মিটারগুলো সংযোজন করা হয়েছিল। এরপর কিছু কিছু গ্রাহক ব্যক্তিগতভাবে বাজার থেকে কিনে প্রি-পেইড মিটার সংযোজন করেছেন। নতুন প্রি-পেইড মিটার সরবরাহ দেওয়ার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখেছি।’
বেসরকারি পর্যায়ে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ গ্রাহকদের মাঝে প্রি-পেইড মিটার সংযোজনের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পিডিবি থেকে সরবরাহকৃত মিটারেরও টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হয়। এখন গ্রাহকদের মাঝে চাহিদা থাকায় বাজার থেকে প্রি-পেইড মিটার সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি কোনো ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। তাছাড়া পিডিবি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মিটার সংগ্রহ করে গ্রাহকদের সরবরাহের প্রক্রিয়া নিয়েছিল। কিন্তু জটিলতার কারণে প্রক্রিয়াটি নির্ধারিত সময়ে এগোয়নি।’
উল্লেখ্য, সারাদেশে আগে থেকেই বিদ্যুৎ চুরিসহ ব্যবহারে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছিল। ভুতুড়ে বিল দেওয়া, মিটার রিডিং ছাড়াই বিল দেয়া, মিটার ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ চুরি, বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পিডিবির অসৎ কিছু কর্মকর্তাদের ম্যানেজের মাধ্যমে কমিয়ে বিল পরিশোধের কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এসব অনিয়ম ঠেকাতে প্রি-পেমেন্ট মিটারিংয়ের মাধ্যমে বিল আদায়ের প্রকল্প নেয় সরকার।