সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে একশত আসনের জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন বলেছেন, উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ১০০। নিম্নকক্ষের ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনে প্রতিটি দলের যে ভোট পাবে সে অনুপাতে উচ্চকক্ষের সদস্যরা মনোনীত হবেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। খবর বিডিনিউজের।
এদিন ছিল ঐকমত্য কমিশেনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের ২৩তম দিনের আলোচনা। দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়ায় এবং ভিন্নমত থাকায়, বিষয়টি কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। সেই দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে কমিশন এ সিদ্ধান্ত জানায়। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপি একমত হয়েছে। তবে পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে বিএনপিসহ কয়েকটি দল।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে, অর্থবিল ব্যতীত অন্য সব বিল নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ উভয় কক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। এক মাসের বেশি বিল আটকে রাখলে, সেটিকে উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য করা হবে।
নিম্নকক্ষের প্রস্তাবিত বিলগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করবে উচ্চকক্ষ এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা অনুমোদন অথবা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, তবে উভয় কক্ষে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। আর যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তা সংশোধনের সুপারিশসহ নিম্নকক্ষে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে। নিম্নকক্ষ সেই সংশোধনগুলো আংশিক বা পূর্ণভাবে গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
বিএনপি এবং তাদের মিত্র জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি–এলডিপির দাবি, উচ্চকক্ষের আসন নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে দিতে হবে। তারা উচ্চকক্ষের এখতিয়ার নিয়েও আপত্তি তুলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি–সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের কোনো প্রয়োজন নেই।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে এই কমিশন, যার নেতৃত্বে আছেন খোদ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। যেখানে সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০, নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি।
১৫ জুলাই ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন থাকলেও এর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার এখন কমিশনের। এ সিদ্ধান্ত পরে জানানোর কথা বলেছিলেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের পক্ষে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান। কমিশনের সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপিও।
বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল–ঐক্যমত্যের বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন, যার পদ্ধতি এখনও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, ফলে একটি অস্পষ্টতা থেকেই গেছে। আমরা কমিশন এবং আলী রীয়াজ স্যারের কাছে আহ্বান জানাবো যে, বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে যেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলা ও কার্যকর আলোচনা হয়। কমিশনের প্রস্তাবিত সময়সীমাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি এবং চাইছি যেন এটি তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিতরা প্রকৃত নির্বাচিত প্রতিনিধি নন, এমন কথা অনেকেই বলছেন তুলে ধরে আখতার বলেন, সারা পৃথিবীতেই এফপিটিপি (ফার্স্ট–পাস্ট–দ্যা–পোস্ট) ও পিআর উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বৈধতা রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও জনগণের প্রতিনিধি। যেসব দল এক শতাংশ ভোট পেলেও তারা যেন একজন করে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি দিতে পারেন, এতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের আরো বিস্তৃত রূপ প্রতিষ্ঠিত হবে। আইন পাসের আগে উচ্চকক্ষে ব্যাপক আলোচনা হবে, যা এখন হয় না। এতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সঠিক ত্রুটি ধরার সুযোগ থাকবে এবং সংসদের বাইরে জনপরিসরে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হবে।
আখতার হোসেন বলেন, বর্তমানে যেভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে, সেটি যেন না হয়। বরং উচ্চকক্ষে যদি পিআর পদ্ধতিতে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা থাকেন, তাহলে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টিও জনগণের বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হতে পারবে। মোটাদাগে আমরা উচ্চকক্ষ চাই। এখন অনেকে বলছেন, পিআর পদ্ধতিতে হলে তারা উচ্চকক্ষ চান না। তাহলে প্রশ্ন উঠে তারা আদৌ উচ্চকক্ষ চান কিনা?