প্রতিদিন বন ধ্বংসের ফলে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এমন সময় নিজেদের উদ্যোগে ‘পাড়াবন’ নামে সংরক্ষণের মাধ্যমে বন টিকিয়ে রেখেছেন পাহাড়িরা। আশির দশক থেকে পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এ উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছিল। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই বনজ সম্পদ ব্যবহার করা হচ্ছে না পাড়াবন এলাকাগুলোতে। পাড়ার কোনো ব্যক্তি অথবা নিজেদের সামাজিক প্রয়োজনে বন থেকে বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করার জন্য প্রথাগতভাবে সামাজিক ও যৌথ মালিকানার এ ব্যবস্থার নাম হচ্ছে পাড়াবন বা মৌজা বন।
বান্দরবানে বন সংরক্ষণে ২৩১ পাড়াবন : বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি জুয়াম লিয়ান আমলাই বলেন, বান্দরবান জেলায় সাতটি উপজেলায় ছোট-বড় অসংখ্য পাড়াবন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাড়াবন রয়েছে রুমা উপজেলায়। সেখানে পাড়াবনের সংখ্যা ১১৪টি। এছাড়া রোয়াংছড়িতে ৩২টি, থানচিতে ২৫টি, আলীকদমে ৩৬টি, লামায় ১১টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৭টি ও বান্দরবান সদর উপজলোয় ৬টি পাড়াবন রয়েছে। এসব পাড়াবনের মাধ্যমে একদিকে স্থানীয়রা উপকৃত হচ্ছে অন্যদিকে বিপন্ন বিভিন্ন গাছ রক্ষা পাচ্ছে। এছাড়া পাড়াবনে কিছু বিরল গাছের কারণে পানির উৎস ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও পাড়াবাসীরা রক্ষা পায়।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, আয়তনে একেকটি পাড়াবন ৪০ থেকে প্রায় ৪০০ একর। বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে ২৩১টি পাড়াবন পাওয়া গেছে। তবে দুর্গম এলাকার কিছু পাড়াবনের আয়তন পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি।
পাড়াবন ভিত্তিক কমিটি : পাড়াবন কমিটির অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামের কেউ ইচ্ছেমতো বন থেকে কিছু সংগ্রহ করতে পারে না। শুধু কারো ঘর নির্মাণ এবং পাড়াবাসীদের সামাজিক প্রয়োজনে বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করার জন্য পাড়াবনের সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে কাটার নিয়ম নেই বনের বড় কোনো গাছ এবং পানি ধরে রাখে এমন কোনো গাছপালাও। যার কারণে বনের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সঠিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে পাড়াবন ভিত্তিক কমিটি। কোনো ব্যক্তি অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজন হলে যাচাই-বাছাই করে দেখার পরে বাঁশ অথবা কাঠ সংগ্রহের অনুমতি দেয় পাড়াবন কমিটি।
চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং ম্রো পাড়াবন : বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ের বারো মাইল এলাকার একটি পাড়ায় সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেছে, বাগান পাড়ায় একটি সামাজিক অনুষ্ঠান চলছে। দুই-তিনশজনের খাবারের আয়োজন। রান্নার জন্য দরকার জ্বালানি কাঠের। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল রেনিক্ষ্যং পাড়াবন থেকে।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ইয়াংরু ম্রো বলেন, বন-জঙ্গলে আগের মতো বাঁশ ও কাঠ পাওয়া যায় না। বড় কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলে জ্বালানি কাঠের জন্য একমাত্র পাড়াবনই ভরসা। অথচ একটা সময় যখন যা প্রয়োজন হাতের নাগালেই ছিল। আশপাশে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ায় আমরা সংকটে পড়েছি। পাড়াবন না থাকলে আমাদের আরও অসুবিধায় পড়তে হতো। নিজেদের উদ্যোগে তাই বন রক্ষায় ‘পাড়াবন’ কার্যক্রম শুরু করেছি।
স্থানীয় পাহাড়বাসী কনয়াং ম্রো ও থংপং ম্রো বলেন, কারো একটি ঘর তৈরি করতে হলে প্রচুর পরিমাণ বাঁশ ও কাঠের প্রয়োজন হয়। অসচ্ছল লোকজনের সামর্থ্য নেই এত খরচ করে ঘর তৈরি করার। এখন পাড়াবন থেকে বাঁশ, ছোট গাছ-গাছালি ও কাঠ নিয়ে একটি ঘর তৈরি করা যায়। এতে পাড়ার অসহায় লোকজনের বেশি উপকার হচ্ছে।
পাড়াবাসীরা বলেন, গত বছর পাড়াবন থেকে বাঁশ কেটে ঘর নির্মাণ করেছিল অনেকে। কিনতে গেলে আকারভেদে একটি বাঁশের দাম ৩০ থেকে ৬০ টাকা পড়বে। পাড়াবন থেকে খরচ ছাড়া পাওয়া গেছে। তবে ঘর তৈরি ছাড়া এক পরিবারে শুধু ২০০টি বাঁশ কাটার অনুমতি রয়েছে। এই সিদ্ধান্তে পাড়াবাসীরা উপকৃত হচ্ছে। ক্ষতি থেকে রক্ষা পাচ্ছে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ।
পাড়াবাসী লেংথুই ও পাওরুং ম্রো বলেন, এপ্রিল-মে মাসের দিকে পানি সংকট দেয় পাহাড়ি পাড়াগুলোতে। তখন চাহিদা মতো পানি পাওয়া যায় না। পাড়াবন তৈরি করায় এখন পাড়াবনের ঝিরিগুলোতে এপ্রিল-মে মাসেও পানি পাওয়া যায়। পানি ধরে রাখে এমন কিছু গাছ রয়েছে পাড়াবনে, যেখানে কোনো সময় পানি শুকায় না।
বয়োজ্যেষ্ঠ রেংরাং ম্রো জানান, আগে বড় গাছ ও ঘন বন থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। আগে পাড়ার আশেপাশে নানা প্রজাতির বিশাল গাছ ছিল। না বুঝে অনেকেই গাছ কেটে বিক্রি করে ফেলেছেন। এখন পাড়াবন কমিটি গাছ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু গাছগুলো বড় হতে সময় লাগবে।
রেনিক্ষ্যং পাড়াবন কমিটির সভাপতি পায়া ম্রো বলেন, এ পাড়াবনটি ১৯৯৫ সালে সংরক্ষণের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল। এর আয়তন ৪০ একর। নানা প্রজাতির বাঁশ ও গাছ ছাড়াও রয়েছে লতাগুল্ম উদ্ভিদ। পাড়াবন হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় অনেকে একমত ছিল না। বনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে পাড়াবাসী নিয়ে বারবার বৈঠক করার পর পাড়াবন সংরক্ষণে সবাই একমত হয়েছে।
রুমা উপজেলার রেমাক্রপ্রাংসা মৌজার হেডম্যান সাবলুং বম জানান, তার মৌজার সুংসংপাড়ার পাড়াবন বান্দরবানে সবচেয়ে পুরনো ও বড় পাড়াবন। ১৯৫১ সালে স্থানীয় বম জনগোষ্ঠীর তৈরি করা এ পাড়াবনের আয়তন ৩৯৫ একর। এ পাড়াবনে কড়ই, গর্জন, ধারমারা, সিভিট, গোদা, ছাতিম, গুটগুইট্যা, চাপালিশ, চাম্পা, ডুমুর, বন শিমুল, চালতা, হরিতকি, তুন, বন আতা এবং নানা প্রজাতির বুনো গাছ রয়েছে। প্রাকৃতিক বন না থাকায় অনেক গাছ বিপন্ন হয়েছে। বিলুপ্ত গাছগাছালি পুরনো পাড়াবন ছাড়া আশপাশে আর কোথাও দেখা মেলে না।
বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বনের কোনো বিকল্প নেই। বন থাকলে পশুপাখি ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য আরও সমৃদ্ধ হবে। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ঐতিহ্যগতভাবে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু পাড়াবন বা মৌজাবন সৃষ্টিতে পাড়াবাসীদের আরও সচেতনতা তৈরির প্রয়োজন রয়েছে।












