পাহাড় রক্ষায় সাহসী পদক্ষেপ চান মেয়র

আজাদী প্রতিবেদন

পাহাড়খেকোদের জন্য চাইলেন যাবজ্জীবন দণ্ড ।। পাহাড় রক্ষায় হবে কমিটি ।। পাহাড় না কেটেও বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড করা যেত ।। মতবিনিময় সভায় নানা সুপারিশ | সোমবার , ১২ জুন, ২০২৩ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

পাহাড় না কেটেও বায়েজিদফৌজদারহাট লিংক রোড করা যেত বলে দাবি করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় বেশ উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে হওয়া রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাই। এটা (লিংক রোড) এমন কোনো উঁচু পাহাড় ছিল না। একটু খেয়াল করলে সেখানে পাহাড় না কেটেও রাস্তা করা যেত। ব্যক্তির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। গতকাল নগরের পর্যটন মোটেল সৈকতের সাঙ্গু হলে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম মহানগরের পাহাড় কাটা রোধে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত লিংক রোডটি (সংযোগ সড়ক) নির্মাণ করে সিডিএ। সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটা হয়।

গতকালের মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সহযোগিতায় সভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এতে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা সংক্রান্ত পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক সিকান্দার খান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক ও পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম নগরের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক।

পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী, আকবর শাহ ও পাহাড়তলী থানায়। ওসব এলাকার ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণরূপে এবং ৯৫টি পাহাড়ের আংশিক কাটা হয়েছে। শুধুমাত্র পাঁচলাইশ এলাকায় পাহাড় কাটা হয়েছে ৭৪ শতাংশ। এছাড়া ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ছিল। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক দুই বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে।

সভা থেকে পাহাড় রক্ষায় নানা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পাহাড় কাটা রোধে ২০০৭ সালের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন, পাহাড়গুলোর বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে একটি জরিপ পরিচালনা, পাহাড় কাটা রোধে একটি হটলাইন চালু করা, আর কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে পাহাড় না কাটা, পাহাড় কেটে বাড়ি বা স্থাপনার কোনো পরিকল্পনায় সিডিএ অনুমোদন দেবে না মর্মে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা, পাহাড় কাটা রোধে ও পাহাড়ের সুরক্ষায় সমন্বয় সেল বা আলাদা ইনফোর্সমেন্ট সেল বা টিম গঠন, পাহাড় রয়েছে এমন সকল ওয়ার্ডের জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করা এবং পাহাড়, খাল, ছড়া রয়েছে এসব জায়গায় বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বন্ধ করা।

সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পাহাড় কাটলে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই পাহাড় কাটা বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। আজ থেকে আর একটি পাহাড়ও কাটতে দেয়া যাবে না। যারাই পাহাড় কাটবে তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্মিলিত সমন্বয় করা হবে। ৯৯৯এর মতো পরিবেশ সুরক্ষায় যেন সবাই সাথে সাথে তথ্য দিয়ে ফল পায় সেটা আমাদের করতে হবে। দ্রুততার সাথেই আমরা চট্টগ্রামে একটি কমিটি করব, যাতে আর একটিও পাহাড়ে কোপ না পড়ে।

তিনি বলেন, পাহাড়কে হত্যা করছে দখলকারীরা। ৫০ হাজার, এক লক্ষ টাকা জরিমানা তাদের জন্য নয়। মামলায় এমন হতে হবে, পাহাড়খেকোদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে। নগরে কী পরিমাণ পাহাড় আছে তা হয়তো ধারণা থেকে বলা হয়। বাস্তবে স্বাধীনতা পরবর্তীতে নগরের পাহাড় নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি।

সভায় বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের অনুপস্থিত থাকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, প্রতিনিধি তো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। প্রধান উপস্থিত থাকলে এখানেই অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ। উপস্থিত না থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সঠিক উদ্যোগ নেয়ায় সমস্যা হবে।

তিনি বলেন, অনেক সময় ভুয়া দলিল দিয়ে পাহাড়ের শ্রেণি পরিবর্তন করে সিডিএ থেকে প্ল্যান নেয়া হচ্ছে। তাই সরেজমিন তদন্ত করে সিডিএর প্ল্যান দিতে হবে। তিনি বলেন, অনেকে বলেছেন পাহাড় রক্ষায় সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। তবে চসিকের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা ভাবতে হবে। তারপরও দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। প্রয়োজনে সমস্ত সংস্থাকে একত্রিত করে একসাথে সোচ্চার করতে কাজ করবে চসিক। তবে সকল সংস্থাকে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আজকে আমরা অনেকে এখনে দৃঢ়ভাবে অনেক কথা বলছি। হয়তো কালকে সে দৃঢ়তা থাকবে না। আমাদের সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এগুতে হবে।

সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাধারণ ইমারত নির্মাণে প্ল্যান দেয়। পাহাড় কাটলে সিডিএ জরিমানা করতে পারে না। সেটা করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। তিনি বলেন, আমরা ড্যাপকে ব্যবহার করে পাহাড় কাটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমার সময় আমি পাহাড়ি এলাকায় কোনো প্ল্যান অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেব। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে আমরা পাহাড় রক্ষা করতে পারব।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, হাই কোর্ট এবং সরকারের বিভিন্ন সময়ে জারি হওয়া পাহাড় কাটায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম, কঙবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে কাটা হয়েছে পাহাড়। পাহাড় কেটে কিভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে? ১৯৮৩ সালে সরকারি আদেশ ছিল, চট্টগ্রামের কোথাও কোনো পাহাড় কাটা যাবে না। ২০০৭ সালে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল, ‘জাতীয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন ছাড়া পাহাড় কাটা যাবে না’। উচ্চ আদালত ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আদেশ জারি করেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম, কঙবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটিতে কোনো পাহাড় কাটা যাবে না’। সরকারের বিভিন্ন সময়ে জারি করা আদেশ এবং উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করেই এই অঞ্চলে পাহাড় কাটা হয়েছে। উচ্ছেদ করা পাহাড়ে আবার গাছ লাগানোর কথাও বলা হয়েছে। পাহাড় কেটে কীভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে সেটি আমাদের মাথায় ধরে না। আশা করি আজকের মতবিনিময়ের পর খুব দ্রুততার সাথেই একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি হবে। পাহাড়গুলো সুরক্ষায় সাইনবোর্ড স্থাপনের যে নির্দেশনা তা বাস্তবায়ন হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম নগরের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, আমরা গত কয়েক বছরে মোট ৮৫টি মামলা করেছি। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২০২২ সালে এই মামলার সংখ্যা ২২টি। আমরা যে আইনের ভেতরে আছি তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু চসিক, সিডিএ এবং জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সহযোগিতা না পাওয়ায় আমরা সফল হচ্ছি না। সিডিএ যদি নকশা অনুমোদন না দেয় তাহলে আমরা বাধাগ্রস্ত হবো না।

সভায় উন্মুক্ত আলোচনায় আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলমের জসিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও পাহাড় সুরক্ষায় বনায়ন, আকবর শাহ এলাকাসহ শহরের সকল ওয়ার্ডে পাহাড় নিধন করে চসিকের যত প্রকল্প আছে তা স্থগিত ও বাতিলের দাবি জানান বক্তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১১ জুনকে জাতীয় পাহাড় রক্ষা দিবস ঘোষণার দাবি
পরবর্তী নিবন্ধএখন আবার চিনির দাম বাড়াতে চান ব্যবসায়ীরা