পাহাড় ও কৃষি জমিতে জ্বলছে ইটভাটার চিমনি

খাগড়াছড়িতে অনুমোদনহীন ৩৩ ইটভাটা ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | শুক্রবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির সবুজ অরণ্যজুড়ে এখন ইটভাটার ক্ষত। সবুজ পাহাড় এবং কৃষি জমিতে জ্বলছে ইটভাটার চিমনি। ভাটার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। ভাটা নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ।
জানা গেছে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এসব ভাটার সবকটি ‘অবৈধ’। দেশের কোথাও পরিবেশের এমন বিপর্যয় ঘটছে না বলে মত দিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, প্রশাসন কঠোর হলে ভাটা মালিকদের এসব অপতৎরতা থামানো যেত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইটভাটা বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করলেও খাগড়াছড়িতে চলতি মৌসুমে কোনো অভিযান চালায়নি সংস্থাটি। তবে ইটভাটাগুলোতে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির সবভাটাতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন পুরোপরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এসব লাইন্সেসবিহীন ভাটা থেকে সরকার কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না। খাগড়াছড়িতে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৩৩টি। সরেজমিনে জেলা সদর ৩২ কিমি দূরে গুইমারা উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ৫টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। কয়েকটি ইটভাটায় দেখা যায় অনিয়মের হিড়িক। টিনের চিমনিও দেখা গেছে একটি ভাটায়। উচ্চাত আবার ৪০ ফুটেরও কম। এসব চিমনির ধোঁয়া গ্রাস করছে আশপাশের গ্রাম। লোকালয় বা সৃজিত বাগানের পাশে ইটভাটা স্থাপন বেআইনি হলেও তার তোয়াক্কা করছেন না ভাটা মালিক। এছাড়া ভাটায় কাঠের পরিবর্তে কয়লা পোড়ানোর কথা থাকলেও একটি ভাটায়ও কয়লার দেখা পাওয়া যায়নি।
ইটভাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, কাঠ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। পাহাড় থেকে কেটে নিয়ে আসা হয়। এখানে কয়লা পরিবহন ব্যয়বহুল। তারা আরো জানান, ‘ইটভাটার মালিকেরা সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করে ভাটা চালান। আইন না মানলেও বছরের পর বছর এভাবে ভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে।’ গুইমারার পাশেই লাগায়ো মাটিরাঙা উপজেলা। এখানে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ১৩ টি। উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিমি দূরে টিনের চিমনি ব্যবহার করে বনের কাঠ পোড়ানা হচ্ছে আরেকটি ইটভাটায়। এখানে ইটভাটার কাজে সস্তা শ্রমে শিশুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। শিশু শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি দেড়শ’ টাকা।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে দীঘিনালা উপজেলার দূরত্ব প্রায় ২০ কিমি। উপজেলার বোয়ালখালী পুরাতন বাজার সংলগ্ন এলাকায় কুজেন্দ্র মল্লিকা মডেল কলেজের পাশেই রয়েছে একটি ইটভাটা। ভাটার মালিক রাকিব। তিনি উপজেলার রশিকনগরে আরো একটি ভাটা গড়ে তুলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশেই ভাটা গড়ে তোলার নিয়ম না থাকলেও তা এখানে মানা হয়নি। এসব ভাটার জন্য পাশের ফসলি জমির টপসয়েল কাটা হচ্ছে। প্রায় দুই একরের কৃষি জমি কেটে ভাটায় ইট পোড়ানো হয়েছে। এসব ভাটায় ইট, কাঠ ও মাটি পরিবহনের কারণে গ্রামীণ সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। ছোট সড়কের অধিকাংশ যানবাহন চলাচলের কারণে ধুলোয় ধূসর পুরো এলাকা। এসব ভাটার কারণে অতিষ্ঠ জনজীবন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোছাম্মদ হাওয়া বেগম, পারুল বেগম ও ইউনুস ব্যাপারী বলেন, ‘ব্রিক ফিল্ডে প্রচুর গাড়ি আসা-যাওয়া করে। এসব গাড়ির কারণে আমাদের বাড়ি, সবজির ক্ষেত, আশপাশের বাগানের গাছে ধুলো জমে থাকে। কতবার অভিযোগ করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যখন বড় গাড়ি ভাটায় যায় আশপাশের পুরো এলাকা ধুলোয় অন্ধকার হয়েছে যায়। ধুলাবালির কারণে সব সময় রোগবালাই লেগেই থাকে। ধুলো কারণে চোখ জ্বালাপোড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি রোগ হচ্ছে। এই এলাকা এখন বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে গেছে।’
দীঘিনালার কেবিএম ব্রিকসের মালিক মো. রাকিব বলেন, ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনে যেসব ধারা বা শর্ত দেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে তা মেনে চলা কঠিন। এখানে উন্নয়নের জন্য আমরা ইটভাটা চালু রেখেছি।’
খাগড়াছড়ি ইটভাটা মালিক কল্যাণ সমিতির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ‘বর্তমানে জেলায় ইটভাটার সংখ্যা ৩৩টি। গতবছর ছিল ৩৮টি। ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের কারণে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে আইন করেছে পার্বত্য এলাকায় তা মেনে চলা কঠিন। ফলে এখানে লাইন্সেস ছাড়াই ভাটা চলছে।’
খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সরোয়ার আলম জানান, ‘ইটভাটা সাধারণত নিয়ন্ত্রণ ও অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। বনের কাঠ যাতে পরিবহন করতে না পেরে সেই বিষয়ে আমরা তদারকি করি। টাস্কফোর্স করে ইটভাটায় বনের কাঠ পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।’
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, ‘কোনো ভাটায় যদি গাছ পোড়ানো হয় তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। গতবছর আমরা ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। আইন না মানলে এবার আরো বেশি জরিমানা করা হবে। ’
খাগড়াছড়িতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন কার্যালয় না থাকায় চট্টগ্রাম থেকে তদারকির দায়িত্ব পালন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা খুব শীঘ্রই খাগড়াছড়ির অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিছিয়ে গেল তদন্ত প্রতিবেদনে বাদীর নারাজি শুনানির আদেশ
পরবর্তী নিবন্ধ‘চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে শিল্পকলা একাডেমি’