পাহাড়ে ১১ এশীয় হাতি

জন্মেছে ৩-৪টা শাবক ।। মানুষের সাথে দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ, আছে চ্যালেঞ্জও হাতি অধ্যুষিত এলাকায় এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | বুধবার , ২৭ জুলাই, ২০২২ at ৪:০৩ পূর্বাহ্ণ

নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ বনে টিকে রয়েছে এশীয় হাতি। রাঙামাটি উত্তর বন বিভাগে অন্তত ১১টি হাতির সন্ধান পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত কাচালং স্টেশন অফিসার সজীব মজুমদারের মতে, দীর্ঘ ১১ বছর ধরে এসব হাতি এখানে বিচরণ করছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৩-৪টা হাতির শাবক জন্মেছে। হাতির পালের সাথে শাবকদের হাঁটতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি রাঙামাটি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে চিরসবুজ বনে এসব এশীয় হাতির বিচরণ দেখা গেছে। রাঙামাটির বরকল ও লংগদু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হাতিদের বিচরণ চোখে পড়ে। মূলত এদের আদি আবাস পাবলাখালি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সংরক্ষিত বন থেকে বের হয়ে এরা পাহাড়ি বনে ছড়িয়ে পড়েছে। হাতির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া, আবাসস্থলের গাছপালা কাটা, বনে আগুন দেয়া, কৃষি ও জুম চাষ করা, মানুষের বসতি নির্মাণ হওয়ায় হাতির চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব : বরকল উপজেলার বাসিন্দা মো. সোহরাব হোসেন জানান, ১০ লাখ টাকা খরচ করে বাগান করেছি। কিন্তু হাতি বাগানের উপর দিয়ে চলাচল করার কারণে আমার অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। হাতি একাধিকবার আমার বসতবাড়িতে হামলা করেছে। হাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা এখন রাঙামাটি শহরে বসবাস করছি। গত মাসে আমার বসতবাড়ির লাগোয়া রসুইঘর হাতি আক্রমণ করে ভেঙে দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, হাতি আক্রমণ করে আমার বাড়ি ১০ বার ভেঙেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা এখানে কীভাবে বসবাস করব?
ফারুক হোসেন জানান, এত টাকা খরচ করে বাগান করি। গাছ পরিচর্যা করে বড় করি। হাতি এসে ভেঙে দেয়। আমার বাগানের উপর দিয়ে প্রতিদিন ভোরে হাতি চলাচল করে। সরকার থেকে এখনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। ইস্রাফিল নামে এক কৃষক বলেন, হাতি আমরা তরমুজ ক্ষেত, মরিচ ক্ষেত নষ্ট করেছে। আমরা তো হাতির সাথে যুদ্ধ করে পারব না। সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করে তাহলে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু আমাদের যে ক্ষতি হয় তা কেউ দেখতেও আসে না।
আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও প্রতি বছর গড়ে ২ থেকে ৩ জন মানুষ হাতির আক্রমণে মারা যায়।
হাতিরক্ষায় বন বিভাগের উদ্যোগ : পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় বর্তমানে হাতির সংখ্যা প্রায় ১১টি। হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। মানুষের মাঝে হাতি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে তারা। হাতির আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ রাঙামাটির ভাসান্যদাম। এখানে প্রথমবারের মতো হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর উপায় নিয়ে সেমিনার করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র বলেন, বাচ্চা জন্মানোর সময় এবং পরে মা হাতি অত্যন্ত সতর্ক ও আক্রমণাত্মক হয়। হাতি সাধারণত রাতে চলাচল করে। খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে বা ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করে। হাতির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া, আবাসস্থলের গাছপালা কাটা, বনে আগুন দেয়া, কৃষি ও জুম চাষ করা, মানুষের বসতি স্থাপন ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হওয়ায় হাতির চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এই অঞ্চলে হাতির শাবক জন্মেছে।
তিনি বলেন, বন্যহাতি দিনে অন্তত ১৭-১৮ বার মল ত্যাগ করে, যার ওজন প্রায় ১শ কেজি। মলের মাধ্যমে হাতি বিভিন্ন জায়গা ফলের বীজ ছড়ায়, যা বনায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। হাতি যে পথে যায় তা অন্যান্য বন্যপ্রাণী চলাচলের পথ সৃষ্টি করে। হাতির পায়ের চাপ পড়ে যে গর্তের সৃষ্টি হয় এতে জমা পানি অন্যান্য প্রাণীর মিঠাপানির উৎস হিসেবে কাজ করে। হাতি যৌন পরিপক্বতা লাভ করে ১৫ বছর বয়সে। জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুটি বাচ্চা প্রসব করে। হাতি দিনে ২০ ঘণ্টা চলাচল করে। হাঁটার গতিবেশ ঘণ্টায় ৫-৭ মাইল। কমপক্ষে তিন মাইল দূর থেকে হাতি পানির উপস্থিতি বুঝতে পারে। বনের ভারসাম্য রক্ষায় হাতির বিকল্প নেই।
কাচালং বনের স্টেশন অফিসার সজীব মুজমদার হাতি অধ্যুষিত এলাকায় বন্যহাতি সংরক্ষণের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে মনে করেন। এর মধ্যে রয়েছে বন্যহাতির বিচরণ ভূমির তথা চলাচলের এলাকাসমূহ পুনরুদ্ধার। সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্যহাতি চলাচল নির্বিঘ্ন করা। বন্যহাতির খাদ্য সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর চাষাবাদ পদ্ধতিতে পরিবর্তন। হাতির অপছন্দীয় শষ্যের চাষাবাদ করা। বন্যহাতির বিচরণ ভূমিতে সারা বছরই পানি বা জলাধারের সহজলভ্যতা রাখা।
বন বিভাগের উদ্যোগে হাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় হাতির হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারকে বন বিভাগ ১৮ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। সরকারিভাবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় হাতির সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব অনেকটা কমে এসেছে বলে মনে করছে বন বিভাগের কর্মকর্তারা। হাতির হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বন বিভাগ বরাবর আবেদন করলে যাচাই বাছাই শেষে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজমিয়তুল ফালাহ’য় ১০ দিনব্যাপী শাহাদাতে কারবালা মাহফিল রোববার শুরু
পরবর্তী নিবন্ধপূর্বাঞ্চল রেলে ইঞ্জিন ও বগি সংকট