পাহাড়ে টপসয়েল কাটায় কমছে আবাদি জমি

'এক ইঞ্চি তৈরিতে লাগে ৩শ বছর'

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২ মার্চ, ২০২১ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্যে গড়া। তবে এখানে পাহাড় কর্তন ও বন উজাড়সহ পরিবেশ বিপর্যয়কারী নানা তৎপরতা চলমান। ভৌগলিক গঠনের কারণে এই জেলায় কৃষিজমির পরিমাণ কম। পাহাড়ের পাদদেশ বা উপত্যাকার সমতল ভূমিতে চাষাবাদ করতে হয়। যেটুকু কৃষি জমি আছে তাও দিনদিন চাষাবাদ অযোগ্য হয়ে উঠছে। টপসয়েল কাটায় কমছে আবাদী জমির পরিমাণ। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১৩ অনুযায়ী ‘কৃষি জমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্ত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় এই আইন মানছেন না ইটভাটার মালিকরা। আইন অমান্য করে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভাটাগুলো ইট তৈরিতে কৃষি জমির টপসয়েল ব্যবহার করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষি জমির টপসয়েল কর্তনের মূল ইন্ধনদাতা ইটভাটার মালিকরা। কৃষি জমির মালিকদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তারা টপসয়েল কেটে নিয়ে যান। ইতোমধ্যে জেলার দীঘিনালা, মাটিরাঙা, পানছড়ি ও সদর উপজেলায় টপসয়েল কাটার দায়ে একাধিক ভাটা মালিককে জরিমানা করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফলে এখন জরিমানা এড়াতে গোপনে টপসয়েল কাটেন ইটভাটার মালিকরা। এসব কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকেন এক শ্রেণির দালাল। তারা ইটভাটাগুলোতে মাটি সরবরাহ করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বেতছড়ি, মায়াফাপাড়া ও গুলছড়িসহ অন্তত ৬টি জায়গায় টপসয়েল কাটছেন ইটভাটা মালিকরা। এর মধ্যে গুলছড়িতে অন্তত ১ একর জমি সাবাড় করেছেন তারা। গত মৌসুমেও এসব জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তারা প্রায় ৫ ফুট গভীর খনন করে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটছেন। ফলে টপসয়েল কেটে নেওয়ায় এসব জমিতে আর ফসল চাষের সম্ভাবনা নেই। বর্ষায় বৃষ্টির পানি জমে এসব জমি ডোবায় পরিণত হবে। প্রতিদিন একাধিক ট্রাক এসব জমি থেকে মাটি পরিবহন করছে। একইভাবে দীঘিনালার বেতছড়ি বাজার সংলগ্ন কৃষি জমি খনন করে মাটি নিয়ে যেতে দেখা গেছে। প্রতিদিন ৭টি ট্রাক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি পরিবহন করছে। আর এসব মাটি যাচ্ছে দুইটি ইটভাটায়।
স্কেভেটর চালক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি না নিলেও জমির মালিকের অনুমতি নিয়ে মাটি কাটছি।’
খাগড়াছড়ি জেলায় অবৈধভাবে ৩৩টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘প্রতিদিন কৃষি জমি থেকে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ঘনফুট মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়।’ এসব টপসয়েল কাটা দৃশ্যপট সরেজমিনে দেখতে গেলে ফোন করে সংবাদ না করার জন্য অনুরোধ করেন স্থানীয় একটি ইটভাটার মালিক।
মেরুং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ঘনশ্যাম ত্রিপুরা মানিক ও স্থানীয় বাসিন্দা জীবন চৌধুরী উজ্জ্বল জানান, ‘পার্বত্য এলাকায় কৃষি জমির পরিমাণ কম। তার উপর ভাটার মৌসুম আসলে কৃষিজমির টপসয়েল কেটে ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এমনিতেই পার্বত্য এলাকায় টপসয়েল এর পরিমাণ কম। পাহাড়ের কৃষি জমিতে মাটির উপরি স্তরের ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত টপসয়েল। প্রাকৃতিকভাবে কৃষি জমিতে প্রতি ইঞ্চি টপসয়েল তৈরি হতে সময় লাগে ১শ থেকে ৩শ বছর। ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে কৃষি জমির টপসয়েল ব্যবহার করার কারণে কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।’
খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন এর সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী জানান, ‘অবৈধ ইটভাটায় কৃষি জমির টপসয়েল কাটায় এসব জমি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এখানে প্রভাবশালী চক্র জড়িত। ইটভাটা মালিকরা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে টপসয়েল কিনেন। অনেকে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। একের পর এক কৃষি জমি ধ্বংস হওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, ‘ইটভাটায় কৃষি জমির মাটি ও বনের কাঠ ব্যবহার করায় এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৭ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছেন। আগামীতেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীমা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধস্বামীর সাথে অভিমান চাকডালায় নারীর আত্মহত্যা