পাহাড়ে একবারের বেশি বদলি নয় রাখা যাবে না দুই বছরের বেশি

পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশের পদায়ন নিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, সদস্যদের মাঝে স্বস্তি

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

তিন পার্বত্য জেলায় কর্মরত প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এখন থেকে একজন পুলিশ সদস্যকে মাত্র দুই বছর চাকরি করতে হবে পাহাড়ে। চাকরি জীবনের যে কোনো পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই বছর চাকরি করলেই ওই পুলিশ সদস্যকে দ্বিতীয়বার আর পাহাড়ে বদলি করা যাবে না। সম্প্রতি জারি করা পুলিশ সদর দপ্তরের এক সার্কুলারে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কনস্টেবল ও নায়েকদের বয়স ৪৫ বছর এবং অফিসারদের বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে তাকে পাহাড়ে আর বদলি করা যাবে না বলেও সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় বদলি ও পদায়নের ব্যাপারে নতুন এই নির্দেশনা পুলিশ বাহিনীর প্রায় দুই লাখ সদস্যের মাঝে বড় ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজারের মতো। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত আছেন ৯ হাজার ১শ’ জন। কনস্টেবল, নায়েক, এএসআই, এসআই, ইন্সপেক্টর, এএসপি, এডিশনাল এসপি এবং এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদ রয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। এরমধ্যে সাধারণ থানা পুলিশের পাশাপাশি ট্রাফিক, ট্যুরিস্ট ও নৌ পুলিশও মোতায়ন রয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে হিল অ্যালাউন্স ও রেশন সুবিধা থাকায় অনেকে স্বেচ্ছায় পাহাড়ে চাকরি করেন। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে চাকরি করার লক্ষ্য নিয়েও অনেকে পাহাড়ে আসেন। কিন্তু পুলিশ বাহিনীতে একটি ধারণা বহু বছর ধরে চলে আসছে, যে কোনো সদস্যকে শাস্তি দিতে হলে তাকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি কিংবা বান্দরবানে বদলি করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বদলি করা হয় পাহাড়ে। এদের মধ্যে বহু পুলিশ সদস্যকে এসব ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে চাকরি জীবনে। কার কপালে কখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে ডিউটি করার দায়িত্ব পড়ছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন বহু পুলিশ সদস্য। বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সশস্ত্র গ্রুপের অপতৎপরতার মুখে এলাকার আইন শৃংখলার পাশাপাশি নিজেদের জীবন রক্ষায়ও উদ্বিগ্ন থাকেন বহু পুলিশ সদস্য। একেকজন পুলিশ সদস্যকে আট দশ বছরও পাহাড়ের বিভিন্ন থানায় কিংবা ইউনিটে পদায়ন করে রাখার ঘটনার নজির রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পার্বত্যাঞ্চলে বদলির আতংক পুলিশে শুধু কনস্টেবল কিংবা নায়েকদেরই নয়; পদস্থ অফিসারদের মাঝেও উদ্বেগ সৃষ্টি করার নজির রয়েছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ বাহিনীতে সুনামের সাথে কাজ করা বহু অফিসারকে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পাহাড়ে বদলি করার ঘটনা ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি হওয়া বহু পুলিশ সদস্যের স্বাভাবিক চাকরি জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠার নজিরও রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পাশাপাশি মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের স্বাভাবিক জীবন। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত বহু পুলিশ সদস্যই নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এই অবস্থায় পুলিশের বিভিন্ন থানা এবং ইউনিটে থাকা সদস্যদের মাঝে ‘হিল আতংক’ বিভিন্ন সময় প্রকট হয়ে উঠে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কোনো কারণে একবার পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি হলে সমতলে ফেরার চেষ্টা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সমতলে ফেরার পথ করতে হয়। কেউ কেউ টাকা পয়সা দিয়ে মাস কয়েক বা এক দুই বছরের মধ্যে সমতলে ফিরতে পারেন। কেউবা স্বাভাবিক দেন দরবার করে বদলি হয়ে আসেন। আবার কেউ কেউ বাড়তি সুবিধার জন্য কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে চাকরি করেন। আর বাকিরা আটকা পড়েন।
চট্টগ্রামের নবাগত ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের দায়িত্ব নেয়ার পর পার্বত্যাঞ্চলে কর্মরত বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে জানতে পারেন। যারা বছরের পর বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও সমতলে ফিরতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমানবিক নানা ঘটনার কথাও তিনি জানতে পারেন।
বিষয়টি নিয়ে তিনি পুলিশের আইজির সাথে কথা বলেন। পুলিশের আইজি বিষয়টি জানতে পেরে নতুন একটি নির্দেশনা জারি করেন। যাতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোনো ইউনিটে কোনো পুলিশ সদস্য মাত্র দুই বছর চাকরি করলে চাকরি জীবনে তাকে দ্বিতীয়বার আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা যাবে না। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর যে কোনো ইউনিটে খণ্ড খণ্ড ভাবে চাকরি করলেও সর্বমোট চাকরির মেয়াদ দুই বছর হলে ওই সদস্যকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর বদলি করা যাবে না। অন্যদিকে চাকরির যে কোনো স্তরে একবার পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করলে ওই সদস্যকে দ্বিতীয়বার আর পাহাড়ে বদলি করা যাবে না। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করতে চান সেটি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে। অপরদিকে বিদ্যমান আইনে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত যে কোনো পুলিশ সদস্যকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হতো। এর ফলে বয়ষ্ক পুলিশ সদস্য- যাদের গাড়ি সুবিধা নেই তাদের পক্ষে পাহাড়ে কাজ করা অনেক কঠিন হয়ে উঠতো। বিষয়টি বিবেচনা করে নতুন নির্দেশনায় পুলিশ কনস্টেবল এবং নায়েকদের সর্বোচ্চ ৪৫ বছর এবং অন্যান্যদের (অফিসার) বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বছর পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পদায়ন করা যাবে। এর থেকে বেশি বয়সের কোনো সদস্যকে পাহাড়ে বদলি করা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই বদলি হতে ইচ্ছুক সদস্যরা সমতলে ফিরতে পারেন সেজন্য তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত দুই মাস আগে তাদের নামের তালিকা পুলিশ সদর দপ্তরে প্রেরণ করতে হবে। যাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ওই সদস্যদে সমতলে সুবিধাজনক ইউনিটে বদলি করা যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গত ৪ নভেম্বর স্মারক নম্বর-৪৪.০১.০০০০.০১২.১৯.২১৭.১৯-৩৫৬৭ মূলে চারদফা নির্দেশনা সম্বলিত এই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজির আহমেদ স্বাক্ষরিত এই সার্কুলার পুলিশ বাহিনীর মাঝে স্বস্তি এনে দিয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্যাঞ্চলে বর্তমানে কর্মরত নয় হাজারেরও বেশি এবং সমতলে কর্মরত হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের উদ্বেগেরও স্থায়ী অবসান ঘটিয়েছে।
এ সম্পর্কে গতকাল চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা একটি নির্দেশনা পেয়েছি। এই নির্দেশনা অনুসরণ করেই আমরা কাজ করব। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের চাকরির বয়স দুই বছর হয়েছে তাদের মধ্যে যারা সমতলে ফিরতে ইচ্ছুক তাদের সমতলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, শাস্তিমূলক বদলি বলে কিছু নেই। অপরাধ করলে শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু শাস্তির জন্য কাউকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করতে হয় না। তিনি বলেন, চাকরি জীবনকে আনন্দময় করে তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা যাতে আদায় করতে পারি আমরা সেই চেষ্টা করব। একজন পুলিশ সদস্য স্বস্তিতে থাকলে তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা আদায় করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের ডিআইজি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে শনাক্ত আরো ১০৭
পরবর্তী নিবন্ধবিআরটিএর কাছে ১০ কোটি টাকা চায় চসিক