পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশে মাছ শিকার

একজনের জাল, আরেকজনের নৌকা

কাজী মোশাররফ হোসেন, কাপ্তাই | শনিবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কাপ্তাই লেকের পাড়ে বরইতলী পাড়ায় সপরিবারে বসবাস করছেন আব্দুর রশিদ। একই পাড়ার আরেক পাহাড়ে সপরিবারে বসবাস করেন জুবলিকা চাকমা। পাহাড়িবাঙালি এই দুই পরিবারে আয়ের একমাত্র উৎস হলো কাপ্তাই লেক থেকে মাছ শিকার করা এবং সেই মাছ বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো। কিন্তু মাছ ধরার জন্য অতি প্রয়োজন একটি জাল এবং একটি নৌকা। আব্দুর রশিদের আছে বড় জাল। আর জুবলিকা চাকমার আছে নৌকা। আব্দুর রশিদের জাল এবং জুবলিকার নৌকা দিয়ে তারা কাপ্তাই লেকে মাছ শিকার করে থাকেন।

আব্দুর রশিদ বলেন, একজনের পক্ষে লেকে জাল ফেলা এবং সেই জাল টেনে তোলা সম্ভব নয়। তাই আমি জুবলিকার সাহায্য নিচ্ছি। তার আছে নৌকা। কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন পয়েন্টে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তারা মাছ শিকার করে বেড়ান। একবার জাল ফেলার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। তারপর আস্তে আস্তে জাল টেনে আনেন। এভাবে সারা দিনে ৩ থেকে ৫ বার জাল ফেলেন বলে আব্দুর রশিদ জানান।

জুবলিকা চাকমা বলেন, আমরা সকাল থেকে জাল আর নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সব জায়গায় কিন্তু মাছ থাকে না। কাপ্তাই লেকের চতুর্দিকে অসংখ্য পাহাড় এবং টিলা রয়েছে। এসব পাহাড় ও টিলার কিছু পকেট আছে। সেই সব পকেটে সাধারণত মাছ বেশি থাকে। তাই পকেট চিহ্নিত করে জাল ফেলি। মাঝে মাঝে পানিতে মাছের খাবারও দিয়ে থাকি। একবার জাল তুললে চাপিলা, পুটি, বাচা, শিং, তেলাপিয়া, কাসকি, ফলি, চেপলি ইত্যাদি ছোট মাছ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে বোয়াল, কোরাল, কাতল, রুই, মৃগেল, আইড়, কালাবাউস ইত্যাদি বড় সাইজের মাছও পাওয়া যায়। তবে এখন লেকে পানি বেশি। এই বেশি পানিতে সাধারণত বেশি মাছ পাওয়া যায় না বলেও তিনি জানান।

একবার জাল তুললে কত টাকার মাছ পাওয়া যায় জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ বলেন, এর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কখনো কখনো অনেক মাছ পাওয়া যায়। আবার অতি অল্প মাছও পাওয়া যায়। তবে জাল টানার পর একেবারে মাছ শুন্য কখনো হয়নি। কিছু না কিছু মাছ সব সময় পাওয়া যায় বলেও তিনি জানান। মাছ বিক্রি কোথায় করেন জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাপ্তাই লেকের উপরেই মাছ বিক্রি হয়ে যায়। অনেক পর্যটক প্রতিদিন বিভিন্ন সময় লেকে নৌ বিহারে আসেন। তাদের অনেকেই জানতে চান মাছ আছে কিনা। তাজা মাছ দেখলে পর্যটকরাই সব মাছ কিনে নেন। আবার অনেক সময় স্থানীয় লোকজনও তাদের কাছ থেকে মাছ কিনে নেন। তবে কখনো যদি লেকের উপর মাছ বিক্রি করতে না পারি তখন গবাগনা বাজার এবং কাপ্তাই জেটিঘাট বাজারে নিলেও প্রায় সাথে সাথে মাছ বিক্রি হয়ে যায়।

মাছ বিক্রির টাকা ভাগ হয় কীভাবে জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ বলেন, মাছ ধরা এবং বিক্রি করার ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে কোন লুকোচুরি নাই। কী পরিমাণ মাছ ধরা হলো এবং কত টাকা বিক্রি হলো তা আমরা একে অপরে সাথে সাথে জানতে পারি। মাছ বিক্রির টাকা আমরা সমান সমান ভাগ করে নেই। আবার কখনো কখনো নিজেদের জন্যও আমরা কিছু মাছ রেখে দেই। একদিন আমি মাছ নিলে আরেক দিন জুবলিকা নেয়। এতে করে আমাদের মধ্যে কখনো মতের অমিল হয়নি।

জুবলিকা চাকমা বলেন, কাপ্তাই লেকে মাছ ধরা অনেক কষ্টের কাজ। প্রচণ্ড রোদের মধ্যেও আমরা নৌকা ও জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আবার বৃষ্টির দিনেও আমাদের মাছ ধরা বন্ধ হয় না। এমনকি প্রচণ্ড শীতের সময়ও আমরা যথারীতি মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকি। মাছ ধরা ছাড়া আমদের আয়ের আর কোন উৎস নেই। তাই যত কষ্টই হোক মাছ ধরার জন্য আমাদের বের হতেই হয়। তবে সরকারিভাবে যখন কাপ্তাই লেক থেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তখন আমরা মাছ শিকারে বের হই না। প্রতি বছর ৩ মাস কাপ্তাই লেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। তখন সরকারিভাবে আমাদের পরিবার প্রতি ৩০ কেজি করে চাউল প্রদান করা হয়। নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস বৃষ্টি না হবার কারণে কাপ্তাই লেকে পানি হ্রাস পায়। তখন একটু বেশি পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় বলেও তিনি জানান। আব্দুর রশিদ এবং জুবলিকা চাকমা বলেন, কাপ্তাই লেকে মিলেমিশে মাছ শিকার করি এবং মুনাফাও সমান সমান নিয়ে থাকি। এতেই আমরা খুশি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডলুখালের পাড় দেবে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, দুর্ভোগ
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে বাসের ধাক্কায় সাইকেল আরোহীর মৃত্যু