পাহাড়ি গানের বাহারি ভুবন: ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে’

নাসির উদ্দিন হায়দার | বৃহস্পতিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

 

বাঘাইছড়ির মারিশ্যা গ্রাম। পাহাড়কোলে হ্রদ অথবা হ্রদের বুকে পাহাড়। সেই গ্রামেরই কিশোর অমর শান্তি চাকমা। পড়ে মারিশ্যা উচ্চ বিদ্যালয়ে। একদিন বাবার সাথে নৌকায় চড়ে পাশের গ্রাম থেকে ধান আনতে যায় অমর শান্তি। ছেলেকে নৌকায় বসিয়ে পাড়ায় ঢুকে পড়েন বাবা। তখন আষাঢ় মাস। কাপ্তাই হ্রদে নতুন পানি এসেছে। নতুন পানি পেয়ে আনন্দে লাফালাফি করছে মাছের দল। পানির ওপর উড়ছে পাখিরা। তার ওপরে নীল আকাশে ভাসছে মেঘের ভেলা। দৃশ্যটা কিশোর অমর শান্তি চাকমার মনে গেঁথে গেল। আর তখনই তার পরাণের গহীন থেকে উঠে এলো দুটি পঙতি, ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে মেঘলু দেবাত তগে/ম পরান্নান যেদ মাগে তারার লগে লগে’ (উড়ছে পাখি মেঘে মেঘে মেঘলা আকাশের নিচে/মন আমার যেতে চায় তাদের সাথে সাথে)

এর কিছুদিন পর মারিশ্যা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটা বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। সেখানে গান গাইতে এলো রাঙামাটির ক্ষুদে শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান। রণজিৎ চাকমা ভাষায় ৮১০টি গান গাইল। রণজিতের গান খুব পছন্দ হলো কিশোর অমরের। গান শেষে রণজিৎ দেওয়ানের কাছে ছুটে গেল অমর শান্তি চাকমা। পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা ছোট কাগজ বের করল। সেই কাগজে কাঁচা হাতে লেখা সেই গানটি, ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে…’। গানটি সুর দিয়ে গাইবার জন্য রণজিৎকে অনুরোধ করল অমর শান্তি। গানটি বেশ পছন্দ হলো রণজিতেরও। পাহাড়ের কথা, পাহাড়ি মানুষের কথা, হ্রদের কথা এত সুন্দর করে এত সহজ ভাষায় আগে তো কেউ লিখেননি!

রণজিৎ দেওয়ান গানটি কণ্ঠে তুলে নিল। এক কিশোর গীতিকারের গানে সুর দিল আরেক কিশোর। রাঙামাটি ফিরে গানটি মঞ্চে গাইতে লাগল রণজিৎ। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেটি-‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে মেঘলু দেবাত তগে’। পাহাড়ি গানে এলো নতুন জোয়ার। পরে গানটি সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয় হলো। পাহাড়ি গান হিসাবে ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে’ একটা আইকনিক গানে পরিণত হলো।

এটা ১৯৭৩ সালের কথা। এর আগে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনেক গান গাওয়া হলেও অমর শান্তি চাকমা ও রণজিৎ দেওয়ান জুটি পাহাড়ি গানে নবযুগ সৃষ্টি করলেন। চাকমা ভাষার ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে’ গান শুনে মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ বিভিন্ন ভাষার শিল্পীরাও অনুপ্রাণিত হলেন, নতুন গান বাঁধতে লাগলেন। সেই গান পাহাড় ছাড়িয়ে সমতলেও আলোড়ন তুলল। বেতারটেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হতে লাগল পাহাড়ি গান। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অডিও প্রতিষ্ঠানগুলোর নজর পড়ল পাহাড়ি শিল্পীদের ওপর, একের পর এক অডিও ক্যাসেট বের হতে থাকল। বিশেষ করে বৈসাবী উৎসবের আগে পাহাড়ি গানের অডিও অ্যালবাম তৈরির হিড়িক পড়ল। ১৯৯৬ সালে শান্তিচুক্তির পর বিটিভিতে পাহাড়ি গানের প্রচার বেড়ে গেল। এভাবে বিগত অর্ধশতাব্দীতে তৈরি হলো পাহাড়ি গানের অপরূপ এক ভুবন।

২০১৪ সালের গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম পাহাড়ি গানের দিকপাল গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক রণজিৎ দেওয়ানের বাসায়। পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক সুপ্রিয় চামকা। রাঙামাটি শহর থেকে দক্ষিণে একটি পাহাড়ি রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলে রাঙ্গাপানি গ্রাম, সেখানেই শিল্পী রণজিৎ দেওয়ানের বাড়ি টিনের ছাউনি, বাঁশের দোয়াজারা বেড়ার ঘর। সেই সন্ধ্যায় সরস কাঁঠাল দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন দাদা। পাহাড়ি গান নিয়ে, পাহাড়ি মানুষের জীবন নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। বেশকটি পাহাড়ি গান নিজের হাতে বাংলা তরজমাসহ লিখে দিয়েছিলেন আমার খাতায়।

রণজিৎ দেওয়ান বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে বেতারে অনিয়মিতভাবে পাহাড়ি গান প্রচার হতো। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলা গানের প্রচলন ছিল বেশি। সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, সুনীতি বিশ্বাস বড়ূয়া, হিমাংশু বিশ্বাস, কল্যাণ মিত্র ত্রিপুরাসহ আরো কিছু শিল্পীর কণ্ঠে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ আদিবাসী ভাষার গান শোনার জন্য পাহাড়ের মানুষ অপেক্ষায় থাকতেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়ি গানে নতুন জোয়ার আসে।’

শিল্পী রণজিৎ দেওয়ানের মতে, পাহাড়ি গানের বড় অংশই হলো দেশাত্মবোধক ও প্রেমের গান। দেশাত্মবোধক গানের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হলো সত্তরের দশক থেকে চলা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকারের আন্দোলন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি, প্রেম ও মানুষের সহজসরল জীবনধারা নিয়েও অসংখ্য গান তৈরি হয়েছে।

অডিও বাজারে ধস নামার পর পাহাড়ি গানের বাণিজ্যিক রমরমা না থাকলেও গানের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি, কমেনি প্রচারপ্রসারও। আবার তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন। বিভিন্ন চ্যানেলের সংগীত প্রতিভা অন্বেষণ অনুষ্ঠানে পাহাড়ের শিল্পীরাও অংশ নিচ্ছেন। ২০১৩ সালে বান্দরবানের সন্তান মং উচিং মারমা ‘বাংলাদেশী আইডল’ এর মুকুট জয় করেছেন। চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ ২০১০ এ তৃতীয় হয়েছেন খাগড়াছড়ির পায়েল ত্রিপুরা, ক্লোজআপ ওয়ান ২০১২এ সেরা ২৪ জনে ছিলেন জলিপ্রু মারমা। এছাড়া তিশা দেওয়ান তরুণদের ক্রেজ তাহসানের সাথে গান করেন। জাতীয় পর্যায়ে তরুণ শিল্পীদের এই সাফল্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী গানের কদর বাড়িয়েছে। যদিও ‘বাংলাদেশী আইডল’ মং উচিং মারমাসহ অন্যরা বাংলা গান গেয়ে রিয়েলিটি শো মাতিয়েছেন। তবে তারা টেলিভিশন ও মঞ্চে আদিবাসী ভাষার গানও করেন। এতে জাতীয় পর্যায়ে পাহাড়ি গানের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাহাড়ে বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীও তৈরি হয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে পাহাড়ি গানের দল ‘রাঞ্জুনি’ সমতলেও বেশ জনপ্রিয়।

তবে আশার পিঠে আছে হতাশাও। তিন পার্বত্য জেলায় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট থাকলেও এগুলো কর্তা ব্যক্তিদের অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞতার কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার গানের বিকাশে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। আবার রাঙামাটিতে একটি বেতারকেন্দ্র থাকলেও সেখানে পাহাড়ি গানের মূল ধারার শিল্পীরা তেমন জায়গা পান না। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা শহরগুলোতে মানসম্মত রেকডিং স্টুডিও নেই, ভালো যন্ত্রী ও দক্ষ রেকর্ডিস্টের সংখ্যাও কম। তবে আছেন ভালো মানের শিল্পী, যারা অডিও অ্যালবাম, মিউজিক ভিডিও, ইউটিউব, ফেসবুক বা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে পাহাড়ের গানকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

পাহাড়ি গানের হাল অবস্থা নিয়ে কথা বলেছিলাম লোকসংগীত গবেষক ও বাংলা একাডেমির উপ পরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করা বিভিন্ন গোত্রের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ বৌদ্ধ কবিদের অমর কীর্তি। সে হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগীতেও রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্য। সেখানে রয়েছে সমৃদ্ধ গ্যাংখুলি গীত, বৌদ্ধ কীর্তন। পাহাড়ের এসব আদি সংস্কৃতি কিন্তু এখনো ধরে আছেন প্রবীণরা, যাদের প্রথাগত শিক্ষা নেই। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ব্যাপারে তেমন সচেতন নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিশ চ্যানেলে স্থানীয় শিল্পীদের প্রচুর মিউজিক ভিডিও প্রচারিত হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেসব গান বেশ জনপ্রিয়ও হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার গানে বাংলা ও হিন্দির প্রভাব বেশ লক্ষ্যণীয়। এসব গানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দিনদিন কমছে।’

ষাটের দশকে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে পুঁথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গান, নাটক ও মেয়েলী গীত সংগ্রহ করেছিলেন। শিল্পকলা একাডেমিও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহশালা তৈরি করেছে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার। আরো দরকার নতুন প্রজন্মকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক শিক্ষাটা দেওয়া। এটা সম্ভ্ভব হলে পাহাড়ি গানের ঐতিহ্য কখনো বিলুপ্ত হবে না।

আশির দশকে পাহাড়ি গানের অডিও অ্যালবাম বাজারে আসতে শুরু করে। ওই সময় চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রাঙামাটির গ্যাংখুলি শিল্পীগোষ্ঠীর পাঁচটি অডিও অ্যালবাম তৈরি হয়। তখন আরো ১৮২০টি অডিও ক্যাসেট স্থানীয়ভাবে বাজারে আসে। ওই সময় অডিও রণজিৎ দেওয়ান, সাহানা দেওয়ান, আল্পনা চাকমা, সুরেশ ত্রিপুরা, উত্তম খীসা, রূপায়ন দেওয়ানসহ অনেক শিল্পীর গান বেশ জনপ্রিয় ছিল। তখন রণজিৎ দেওয়ানের ‘মর চব্বিশ বছরর কোচপানা (আমার চব্বিশ বছরের প্রেম) অ্যালবামটি বেশ জনপ্রিয় হয়। এছাড়া, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও পাহাড়ি গানের প্রচারপ্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় শিল্পীদের গানের অ্যালবাম তৈরি করে দেয়। জুম ইসথেটিক কাউন্সিল (জ্যাক), গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, মানিকছড়ির মারমা শিল্পীগোষ্ঠী এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

২০১০ সালের দিকে ক্যাসেট যুগ ম্রিয়মান হতে শুরু করে। তবে তার আগের দশেক পার্বত্য চট্টগ্রামে রণজিৎ দেওয়ানের ‘মন পহরের সদগে’, আল্পনা চাকমার ‘ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলে’, পঠন চাকমার ‘রাঙামাইত্যার কর্ণফুলী’, মনোজ দেওয়ানের ‘আমার হিল চাটিগাঁ’ এবং শুভা তালুকদার ও পাপড়ি চাকমার ‘দলক’ অডিও অ্যালবামগুলো ছিল সুপারহিট।

চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের পুরোনো অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোরে দীর্ঘদিন ক্যাসেট প্রযোজনা বিভাগের প্রধান ছিলেন নুরুল হক। পরে তিনি শাহ আমানত অডিও কমপ্লেক্স নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেন। ১৯৮০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর তিনি চট্টগ্রামের অডিও জগতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পাহাড়ি গানের বাণিজ্যিক যুগ প্রসঙ্গে নুরুল হকের সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। তার কথাগুলো তুলে ধরা হলো ‘আশির দশক থেকে ক্যাসেট কাজারে পাহাড়ি গানের কাটতি বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা গানের বেশ চাহিদা ছিল। প্রতিবছর বৈসাবিতে শুধু আমিন স্টোর থেকে পাহাড়ি গানের শিল্পীদের শতাধিক অডিও ক্যাসেট বের হতো। ২০০৫ সাল থেকে পাহাড়ি গানে অডিও ক্যাসেটের পাশাপাশি মিউজিক ভিডিও’র চাহিদা বাড়তে থাকে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে। সে সময় আমরা জনপ্রিয় শিল্পীদের গানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করতাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের মনোরম লোকশেনে হতো সেসব গানের শ্যুটিং। তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটে উঠত।’

পাহাড়ি গানের মুকুটহীন সম্রাট রণজিৎ দেওয়ান ১৯৬৭ সালে তিনি যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন তখন বেতারে একটি চাকমা গান ‘কর্ণফুলী দুলি দুলি হদু যাইবা হনা’ (কর্ণফুলী তুমি দোল খেয়ে কতদূর যাবে) শুনে সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি একাধারে গীতিকার ও সুরকার। এ পর্যন্ত ১৫০ গান লিখেছেন। ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির পর খালিদ মাহমুদ মিঠু রণজিৎ দেওয়ানের বিখ্যাত ‘উত্তোন পেগে মেঘে মেঘে’ গানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন। সেটি বিটিভিতে প্রচারিত হলে চারদিকে আলোড়ন তুলে। রণজিৎ দেওয়ানের আরেকটি বিখ্যাত গান হলো ‘ন চাং যেবার এ জাগান ছাড়ি’ (এই দেশ ছেড়ে যেতে চাই না), এটা একটি দেশাত্মবোধক গান। সমপ্রতি ক্লোজআপ ওয়ান তারকা নিশিতার কণ্ঠে গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

প্রসঙ্গত, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর খালিদ হোসেন মিটু ‘রূপের সবুজ পাহাড়’ নামে আরো একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন। সেই মিউজিক ভিডিও’র গানগুলো পাহাড়ে সাড়া জাগায়। সুব্রত চাকমা ‘জুম কাবা যেই’ নামে মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন। এতে পরিকল্পিতভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।

বর্তমানে পাহাড়ি গানের জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, রণজিৎ দেওয়ান, সম্রাটসুর চাকমা, মনোজ বাহাদুর, সুব্রত চাকমা, পঠন চাকমা, রেসি চাকমা, রলি চাকমা, নেত্রী রায়, সমিত চাকমা, নীলা দেওয়ান ও সৌরভ চাকমা। খাগড়াছড়িতে জনপ্রিয় শিল্পী হলেন ক্রাঞোরী মারমা। তাঁর কণ্ঠে অংপাইরি মারমার লেখা ‘নিংলে ক্যাহদ্মা দিয়া’ (সন্ধ্যা নেমে এলো, চলো বাড়ি যাই) গানটি এখন বেশ জনপ্রিয়। ওই অঞ্চলে গান লিখে নাম কুড়িয়েছেন গীতিকার রতন ত্রিপুরা। রাঙামাটি অঞ্চলে জোনাকী চাকমা, দোয়েল চাকমা, রুবেল চাকমা প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী।

বছর কয়েক আগে কথা হয়েছিল খাগড়াছড়ির শিল্পী ক্রাঞোরী মারমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতি, দেশপ্রেম ও নরনারীর প্রেম নিয়েই মূলত পাহাড়ি গান রচিত হয়। পাহাড়ে নারী শিল্পীদের জনপ্রিয়তা দারুণ। অডিও বাজারে ধস নামার পরও পাহাড়ে ভালো গান হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে গান রেকর্ডিং হচ্ছে, সেসব গান এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড হচ্ছে, দেশেবিদেশে জনপ্রিয়ও হচ্ছে। তবে এখন পাহাড়ি গানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্র তেমন ব্যবহার হয় না।

কথা হয়েছিল বাংলাদেশী আইডল মং উচিং মারমার সাথেও। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য তিন জেলায় আদিবাসী গানের অনেক প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছেন। তবে পাহাড়ে শেখার সুযোগ কম, সংগীতচর্চার সুযোগ আরো কম। পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগসুবিধা পেলে নতুন নতুন শিল্পী তৈরি হবে এবং তারা পাহাড়ি গানের ঐতিহ্যকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারবেন।’ কিন্তু কথা হলো, পাহাড়ি গানে কে দেবে পৃষ্ঠপোষকতা, কে করবে যত্ন?

লেখক: সাংবাদিক ও লোকসংগীত গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের কালজয়ী আঞ্চলিক গান
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক তৎপরতার বিকাশধারা : প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল