কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দুটো মারাত্মক অন্যায় কাজের অভিযোগ উঠেছে। একটা হলো পাহাড় কাটা, অন্যটা হলো জলাধার ভরাট। যদিও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলেছেন, প্রকল্প এলাকায় কোনো পাহাড় কাটা হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের মধ্যে একটি ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলের পাহাড় রয়েছে, যা বর্ষাকালে মানুষের জীবনযাত্রার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ঝুঁকি কমাতে নারিকেলগাছ লাগানোর জন্য ওই অংশকে ৪৫ ডিগ্রি ঢাল করা হচ্ছে। সেখানে কোনো নির্মাণকাজ করা হবে না এবং পাহাড় ধস রোধে এ কাজ চলছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে পাহাড় কেটে জলাধার ভরাট করছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আবাসিক ফ্ল্যাট উন্নয়ন প্রকল্প–১’ এলাকায় ১০ দিন ধরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়।
গত রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলী বাইপাস সড়কের পাশে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন আবাসিক ফ্ল্যাট উন্নয়ন প্রকল্প–১ এলাকায় নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের পূর্ব পাশে বিশাল আকৃতির পাহাড়। বিভিন্ন গাছপালা ও জঙ্গলে ভরপুর পাহাড়ে লাগানো হয়েছে দুটি এস্কেভেটর। কউকের দুটি এস্কেভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে পুরো একটা পাহাড়। প্রথম এস্কেভেটর পাহাড়ের চূড়া থেকে মাটি কেটে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। আরেকটি এস্কেবেটর ট্রাকে তুলে দিচ্ছে মাটি। মাটিগুলো নিয়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তার পাশে জলাধারে।
পাহাড় কেটে জলাধার ভরাট করার নিন্দা জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম এরশাদ বলেন, পাহাড় কাটা সাধারণ মানুষের জন্য যেমন অন্যায়, সরকারি কর্মকর্তারা জেনেশুনে পাহাড় কাটলে সেটা আরো বেশি অন্যায়। অবিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধ করে পাহাড় কর্তনকারীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিবেশবিদদের মতে, জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু টেকনিক্যাল এবং সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিকও বটে। এ দায়িত্ব সবার হলেও মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পালন করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এ দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা দেখা যায়। ফলে জলাধার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁরা বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো জলাধার রক্ষা করে নগরায়ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইতালির ভেনিস, যুক্তরাজ্যের লন্ডন এর জীবন্ত উদাহরণ। কিন্তু আমাদের দেশে যেখানে নদী দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়, সেখানে জলাধার দখল করা হয়তো তুচ্ছ বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু এতে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, উষ্ণতা বাড়ছে। তার ফলাফল মোটেও ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না। তাই জলাধার যত ছোট আয়তনের হোক না কেন, সেটি রক্ষায় অবহেলা কাম্য নয়।
অন্যদিকে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় কাটা রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের জন্য ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দান করেছিলেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেছিলেন, এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে চলতি ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে দেশের বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যে বনায়ন ও বন সংরক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ জন্য বনভূমি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ১৯২৭ সনের বন আইনের ৪ ও ৬ ধারায় প্রকাশিত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত এমন সকল বনভূমিকে ২০ ধারায় সংরক্ষিত বন ঘোষণার প্রক্রিয়া গ্রহণের লক্ষ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব প্রেরণের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা প্রদান করেন।
পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ– দিনের পর দিন পাহাড় কেটে বসতি নামের মৃত্যুপুরী গড়ে তোলা হলেও তা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের যেন কোন মাথা–ব্যথাই নেই। অথচ পাহাড় কাটা রোধ ও বিপন্ন হওয়া থেকে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের আইনগত প্রতিষ্ঠান এটি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর যেন ঘুমিয়েই থাকে সারাবছর। যতক্ষণ তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ না আসে কিংবা গণমাধ্যমে রিপোর্ট না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার ধূম চললেও তাদের তেমন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। কক্সবাজারে পাহাড় কাটা ও জলাধার ভরাটের বিষয়েও কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাধার রক্ষা করতে হলে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে জলাধার রক্ষা করা কঠিন। জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করার জন্য আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা প্রয়োগ করছে, তা বন্ধ করা জরুরি। না হলে জলাধারগুলো আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। একবার কোনো জলাধার ভরাট হয়ে গেলে তা উদ্ধার করা খুব কঠিন। তাই এখনো যেটুকু জলাধার অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করতে হবে।