পাহাড় কাটার কৌশল এবার অন্যরকম

নগরে রাতেও কাটা হয় পাহাড়, মামলা-জরিমানায় থামছে না রাতে অভিযানে যাওয়ার মতো জনবল নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের

হাসান আকবর | সোমবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

পাহাড় কাটার কৌশলটা এবার অন্যরকম। অভিনবই বলতে হবে। পাহাড়ের ঘাস আর মাটি কেটে স্তরে স্তরে ভাগ করে তৈরি করা হয়েছে জমি। কোনোটাতে সবজি চাষ করা হয়েছে, কোনোটাতে এখনো বীজ ফেলা হয়নি। চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানাধীন ওয়ার্লেস এলাকার বিএডিসি রোডের কাঁঠালবাগানে মাদানী নগরের একটি পাহাড়ের দৃশ্য এটি। স্থানীয়রা বলছেন, এটি পাহাড় কেটে শেষ করার একটি কৌশল। পাহাড় উপরের অংশে এমনভাবে কাটা হয়েছে, বর্ষায় ধসে পড়বে মাটি। তারপর ধীরে ধীরে মাটি কেটে আরো সমতল করা হবে। ওই এলাকার আশপাশেও পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্লট।

চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা থামানো যাচ্ছে না। নিত্য নতুন এবং অভিনব কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়। প্রভাবশালীদের ধরন বদল হয়েছে, কিন্তু পাহাড় কাটার চিত্র একই রয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করেছে, জরিমানা করেছে। কিন্তু থামছে না পাহাড় কাটা। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে অন্তত ১২০টি পাহাড় নিচ্ছিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। বাকি যে পাহাড়গুলো আছে সেগুলোও কেটে চট্টগ্রামকে পাহাড়শূন্য করার তোড়জোড় চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার কথা স্বীকার করে বলেছে, লোকবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় পাহাড়খেকোদের ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে নগরীর পাঁচটি থানা এলাকায় ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ছিল। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে ঠেকে। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কেটে ফেলা হয়। এটি মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ বলে একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো এলাকার সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ এবং প্রতিবেশ রক্ষায়ও রেখে আসছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু জমির মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এক শ্রেণির মানুষ পাহাড় কাটায় মেতে ওঠে। রাতেদিনে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয় বড় বড় আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবন। আইনের শিথিলতাসহ নানা দুর্নীতির কারণে পাহাড়খেকোদের সামলানো যায়নি। দিনের পর দিন নগরীর বিভিন্ন এলাকার পাহাড় কেটে শেষ করা হয়েছে।

গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশ থানায়। ওখানে প্রায় ৭৪ শতাংশ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। ত্রিশ বছর নগরীতে ১২০টির মতো পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে। নগরীতে আগে ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতোমধ্যে ১২০টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ৮০টির মতো পাহাড় টিকে আছে। এখন এগুলোও হুমকির মুখে।

পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করেছে, জরিমানা করেছে। কিন্তু কিছুতেই তাদের থামানো যাচ্ছে না। পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদপ্তর, ভূমি অফিস এবং পুলিশ মিলে পাহাড়ে মালিকানা রয়েছে এমন শতাধিক ব্যক্তিকে দাওয়াত দিয়ে সভা করে। সভায় আর পাহাড় না কাটার ব্যাপারে উপস্থিত সকলকে শপথ করানো হয়। কিন্তু সেই শপথ রাখছে না অনেকে। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর রৌফাবাদ, খুলশীর জালালাবাদ এবং আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। পাহাড় কাটা চলছে ফয়’স লেক ও জঙ্গল সলিমপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পাহাড়খেকোদের ধরন পাল্টালেও পাহাড় কাটা চলছে একই গতিতে।

এদিকে ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোডের পাশের সুউচ্চ অনেক পাহাড়ে রাতেদিনে কাটা হচ্ছে। সংববদ্ধ একটি চক্র বিশাল এলাকা নিয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটেছে জানিয়ে স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, ইতোপূর্বে কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড়খেকোদের দমাতে পারেনি। অভিযানের খবর আগেভাগে পেয়ে তারা গা ঢাকা দেয়। দুর্বৃত্তরা মামলাকে পাত্তা দেয় না মন্তব্য করে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাহাড় কাটা নিয়ে একাধিক মামলা হলেও পাহাড়খেকোরা দমেনি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড় কাটার ব্যাপারে তারা অভিনব সব পন্থা অবলম্বন করছে।

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জায়গার মূল্যবৃদ্ধি চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর জন্য ‘কাল’ হয়েছে। পাহাড়ে মালিকানা রয়েছে এমন পাহাড়ের সাথে সাথে সরকারি মালিকানাধীন পাহাড়ও অবৈধ দখলদাররা কেটে ফেলছে। এরা নানা পন্থায় পাহাড় কাটছে। রাতের আঁধার নামার সাথে সাথে তাদের পাহাড় কাটা শুরু হয়। চাঁদনি রাতগুলোতে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দিনের বেলায় পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযানে গেলেও কাউকে পায় না। রাতে অভিযানে যাওয়ার মতো লোকবল এবং নিরাপত্তা পাওয়াও কঠিন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে আমরা মামলা আর জরিমানা করতে পারি। কিন্তু সেটি দিয়ে তাদের দমানো যাচ্ছে না। পাহাড়খেকোদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে চট্টগ্রামের বাকি পাহাড়গুলো কয়েক বছরের মধ্যে অস্তিত্ব হারাবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুলাই থেকে ট্রেইনি চিকিৎসকদের ভাতা ৩৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে গভীর রাতে ফার্নিচারের দোকানে ভয়াবহ আগুন