পাহাড় কাটা নিয়ে আর টম অ্যান্ড জেরি খেলতে চান না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে আমরা গতকাল জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। আপনারা তো আমাকে আগে থেকে চেনেন। পাহাড় কাটে; আমি আসি আর বন্ধ করি। এভাবে টম অ্যান্ড জেরি আমি আর খেলতে পারব না। আমি আসব, ফোন করব, আপনি যাবেন, পাহাড় কাটা বন্ধ হবে; কাল আবার পাহাড় কাটবে। গতকাল রোববার নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত পলিথিনবিরোধী এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিভাগীয় কমিশনার পাহাড় কাটার একটা তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা বারবার বলেছি, তালিকায় মালিকদের নাম দেবেন, তারা দেননি। এখন বলছি, তালিকা পূর্ণ করে মালিকদের নাম দিন। পাহাড় যখন কাটবে মালিককে গ্রেপ্তার করবেন, শ্রমিকদের নয়। দুজন মালিককে গ্রেপ্তার করবেন, পাহাড় কাটা বন্ধ হবে। এই টম অ্যান্ড জেরি খেলা আর আমাকে দিয়ে খেলাবেন না।
প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, তারা রাতে পাহাড় কাটে। রাত জেগে পাহারা দেবেন। এটা আপনার দায়িত্ব। এটা সরকারের আইন। ৯টা–৫টা অফিস কোনো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী করতে পারে না। কেউ বলতে পারবে না আমার অফিস টাইম ৯টা থেকে ৫টা। তাকে সব সময় প্রজাতন্ত্রের সেবায় থাকতে হবে।
তিনি বলেন, মালিকদের নাম ধরে চট্টগ্রামের শীর্ষ পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞপ্তি দেবেন। এই দাগ–খতিয়ানে পাহাড় আছে, এগুলো কাটা যাবে না। তারপর চট্টগ্রাম শহরের কোথায় কোথায় পাহাড় আছে একটা স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করেন। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ, বন বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ সব সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে এটা করতে হবে। চট্টগ্রামকে সাতটা ভাগে ভাগ করে ফেলেন। সাতটা কর্মকর্তা সাতটা ভাগের দায়িত্বে থাকবে।
তিনি বলেন, রাত দুইটার সময় এসএমএস আসে, আপা অমুক জায়গায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। আমি ঘুম ভাঙিয়ে তিনটার সময় সেটি পাঠাই। উনারা আবার লোক জোগাড় করতে করতে ছয়টা। পাহাড় কাটা শুরু হয়েছে রাত ১১টায়, সাতটার মধ্যে পাহাড় কাটা শেষ।
তিনি বলেন, আপনি যদি গাছ কেটে ফেলেন, গাছ লাগাতে পারবেন। নদী দখল করে ফেললে দখলদার উচ্ছেদ করতে পারবেন। আপনাদের মধ্যে যদি কারও পাহাড় কেটে ফেলার পর পাহাড় সৃষ্টি করার জাদু থাকে তাহলে আমাকে বলে দেবেন। যদি জাদু জানা না থাকে তাহলে পাহাড় কাটতে দেওয়া যাবে না। আপনারা তালিকায় মালিকের নাম দেবেন। সব মালিককে আপনারা রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি পাঠাবেন। এটা আপনার পাহাড়, আপনি আর কাটবেন না। সরকারি আইনে অপরিহার্য জাতীয় প্রয়োজন ছাড়া পাহাড় কাটা নিষেধ।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু ২০২৫ সালে এসেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যদি জনগণ তাদের আচরণ পরিবর্তন না করে, তবে সরকার একা এই যুদ্ধ জিততে পারবে না। পলিথিন–প্লাস্টিকের ব্যবহারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের খাবার এবং পানিতে প্রবেশ করে, যা ক্যান্সারসহ গুরুতর রোগ সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিকের এই মাইক্রোপার্টিকলগুলো শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করছে, যা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। একজন মা কিংবা বাবা হিসেবে এ ধরনের বিষাক্ত অভ্যাস বন্ধ করা জরুরি।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, পলিথিনের বিকল্প সব সময়ই ছিল, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করতে আমাদের অভ্যাসগত অনীহা রয়েছে। আপনার দাদা বা বাবা বাজারে গেলে চটের ব্যাগ নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন গাজরের জন্য এক ব্যাগ, মরিচের জন্য আরেক ব্যাগ; এভাবেই পলিথিনের ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে। এটা শুধু আমাদের পরিবেশ নয়, আমাদের সংস্কৃতিকেও দূষিত করছে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে চট, পাট, কাপড় এবং কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, পলিথিন কারখানা বন্ধ করা হবে। পলিথিন কারখানার শ্রমিকেরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে কারখানা মালিকদেরই শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরিবেশ ধ্বংসকারী একটি পণ্যের জন্য জনগণ বা সরকার কেন দায় নেবে?
রুয়ান্ডা ও তানজানিয়ার মতো দেশগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এসব দেশে পলিথিন শপিং ব্যাগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি তানজানিয়াতে পলিথিন ব্যাগ বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তিনি বলেন, রুয়ান্ডার শাসকেরা বলেছেন, গৃহযুদ্ধ আমার যতটা ক্ষতি করেনি, পলিথিন তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আমাদেরও এমন কঠোর নিয়ম তৈরি করতে হবে।
ঢাকার সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাঁচাবাজারসহ অন্যান্য জায়গায় এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আমাদের নেওয়া উদ্যোগের ফলে ঢাকার সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে। চট্টগ্রামেও সুপারশপগুলোতে পলিথিন বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। আপনারা পলিথিন ব্যাগ গ্রহণ করবেন না। দোকানে গেলে নিজস্ব কাপড় বা চটের ব্যাগ নিয়ে যান। আমাদের অভ্যাস পরিবর্তনই পারে পরিবেশকে সুরক্ষিত করতে।
তিনি বলেন, প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি শব্দদূষণ ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আপনার আচরণই এই পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। পলিথিনের মতো ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার বন্ধে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। আপনার ব্যবহার বন্ধ করলেই পলিথিন বন্ধ হবে। এটি শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার লড়াই।
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ২০০৫ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর এটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তবে সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে এবং জনসচেতনতার ঘাটতিতে এটি আবারও ব্যাপকভাবে ফিরে এসেছে। পলিথিন বন্ধে জনসচেতনতা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিটি কারখানা ও বিপণন কেন্দ্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণাগুলো পরিবেশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে, যা আমাদের নালা–নর্দমায় বাধা সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি করছে। এটি নিয়ন্ত্রণে কঠোরভবে আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রায় ৫০ হাজার ময়লার বিন সরবরাহ করছে। প্রতিটি বাজার ও দোকানে এগুলো স্থাপন করা হবে, যাতে ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। দোকানদাররা নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
মেয়র চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনী উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠান ‘১ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ১ কেজি চাল’ বা ‘৪ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে একটি মুরগি’ দেওয়ার কর্মসূচি চালু করেছে। এ রকম কর্মসূচি শুধু প্লাস্টিক অপসারণে সহায়ক নয়, এটি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও কার্যকর।
মেয়র যুবসমাজকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি ও বাজারজাত করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। বলেন, পুরনো শাড়ি বা কাপড় দিয়ে চটের ব্যাগ তৈরি করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি পরিবেশ রক্ষা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে।
শাহাদাত বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এবং আগ্রাবাদের শিশু পার্ককে পুনর্গঠন করে আধুনিক করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৪১টি ওয়ার্ডে ৪১টি খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সাতটি মাঠের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হবে। চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এ লক্ষ্যে আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব শহর গড়ে তুলতে হবে। যখন আমরা পলিথিন এবং প্লাস্টিককে সম্পদে রূপান্তর করতে পারব, তখন আমাদের শহর সত্যিকারের ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন সিটিতে রূপান্তরিত হবে।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ ও প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ বিষয়ে প্রেজেন্টেশন দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সিদ্বার্থ শংকর কুন্ডু। বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দিন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ুন কবির, প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া, সিডিএর বোর্ড সদস্য জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা নদী গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া, নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন, বাপা সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর কবির প্রমুখ।
সভা শেষে কাজির দেউড়ি বাজার পরিদর্শন করে পলিথিনের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।