রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের আর্য্যপুর বিহারে ২০১০ সালে ৩০০টি আগর গাছ ৫৬ লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ প্রিয় চাকমা। এরপর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে উপজেলায় আগর বাগান সৃজনের দিকে ঝুঁকছেন স্থানীয়রা। বর্তমানে প্রতি বছরই আগর বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। পাহাড়ের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে এই আগর–আতর শিল্প। স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে আগর ব্যবসায়ী সমিতিও। তবে প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা আরও সহজ হলে আগর–আতর শিল্প পাহাড়ের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাঘাইছড়ি পৌরসভার বাঘাইছড়ি গ্রামে ২০ শতক সমতল জমিতে আগর বাগান করেছেন রিপন চাকমা। ২০২০–২১ সালে তিনি ৪০০–৫০০টি আগর গাছ রোপণ করেন। এর আগে ২০১২ সালেও লাগিয়েছেন ২০–২১টি আগর গাছ, যেগুলো এখন বিক্রয়ের উপযোগী হয়েছে। রিপন চাকমা জানান, বাঘাইছড়ি উপজেলাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়েক হাজার একর জমিতে আগর বাগান করা হয়েছে। যিনি স্বল্প পরিসরে শুরু করেছেন তারও অন্তত ৪০০–৫০০টি আগর গাছ রয়েছে। এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। একটি আগর গাছ আকার ও ধরণ অনুযায়ী ৫–১০ হাজার টাকা কিংবা তারও বেশি দামে বিক্রয় করা যায়। বাঘাইছড়ি উপজেলার আরেক আগর ব্যবসায়ী জ্ঞানেন্দু চাকমা বলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ১৯৮৪ সাল থেকে আগর বাগান করা হচ্ছে। তবে ২০০০ সাল থেকে উপজেলায় আগর বাগান সৃজনের প্রচলন বেড়েছে। আমার তিনটি আগর বাগানে ১২ হাজারের অধিক গাছ রয়েছে। এরমধ্যে একটি বাগানের গাছ বিক্রয়ের উপযোগী হয়েছে। ২০২২ সালে আমি ৬২টি আগর গাছ সাত লাখ টাকায় বিক্রয় করেছি। চট্টগ্রামের এক আগর ব্যবসায়ী আমার কাছ থেকে গাছগুলো কিনে নেন। বাঘাইছড়িতে এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগর গাছ কিনতে ব্যবসায়ীরা আসছেন। মূলত আগর গাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ আমরা বাড়িতেই করে থাকি। আর আগর তোলা শেষে সাদা কাঠগুলো থেকে আতর উৎপাদন করা যায়। বাঘাইছড়িতে তিনজন আগর ব্যবসায়ী ১৩টি চুলা দিয়ে আগর–আতর উৎপন্ন করছেন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা আগর ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, উপজেলায় বর্তমানে ৬ কোটির অধিক আগর গাছ রয়েছে। বছরে গড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০–২৫ হাজার গাছ। স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াকরণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৩টি চুল্লি।
বাঘাইছড়িতে আগর চাষে সফলতার পথ দেখানো ব্যবসায়ী ও উপজেলা আগর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সন্তোষ প্রিয় চাকমা বলেন, ২০২২ সালে আমাদের করা এক জরিপ অনুযায়ী বাঘাইছড়িতে ব্যক্তিমালিকানায় ৬ কোটির অধিক আগর গাছ রয়েছে। প্রতি বছরে এখানে ২০–২৫ হাজার আগর গাছ বিক্রি হয় এবং ৫ লাখের অধিক আগর গাছ রোপণ করা হচ্ছে। ২০১০ সালে আমি ৩০০টি আগর গাছ ৫৬ লাখ বিক্রি করেছিলাম। এরপর থেকে উপজেলায় ক্রমান্বয়ে আগর বাগান বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় স্থানীয় পাহাড়ি–বাঙালি সকলেরই আগরের ওপর নির্ভরতা বাড়াবে। বলতে গেলে প্রতিটি ঘরে ঘরেই আগর বাগান সৃজন করা হচ্ছে।
এদিকে, বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় কাপ্তাই উপজেলায় যৌথভাবে আগর বাগান গড়ে তোলেন কবির হোসেন। জেলা শহরের আসামবস্তি–কাপ্তাই সংযোগ সড়কের দু’পাশেই গড়ে তোলা হয় আগর বাগান। কবির হোসেন বলেন, ২০০৭–০৮ সালে বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটি–কাপ্তাই সংযোগ সড়কের দু’পাশে আমরা আগর বাগান গড়ে তুলি। বন বিভাগের ভূমিতে তাদের দেওয়া আগর চারা রোপণসহ পরিচর্যার পেছনে আমাদের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সাধারণত ১৫ বছরের মধ্যে সৃজিত বাগান থেকে আগর তেল সংগ্রহ করা হয়। এখন আগর গাছে পেরেক মারার সময় হয়েছে। পেরেক মারার পর ছত্রাক জন্মাবে এরপর আগর তেল উৎপাদন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে বন বিভাগকে আমরা একাধিবার তাগাদা দিলেও তারা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।
পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে আগর বাগান সৃজন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং উপ–বন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পাহাড়ে এখনো আগর বাগানের বাজার ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। মূলত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের একটা প্রকল্প ছিল আগর বনায়ন নিয়ে। তখন বন বিভাগের উদ্যোগেই পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে আগর বাগান সৃজন শুরু হয়েছিল। তখন পাহাড়ের মানুষ আগর বাগান সৃজনে উৎসাহী হন এবং এখন ব্যক্তিগত পর্যায়েও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি–কাপ্তাইসহ বিভিন্ন এলাকায় আগর বাগান করা হচ্ছে। আগর বাগান একটি লাভজনক ব্যবসা। বাঘাইছড়িতে ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হচ্ছে।