পাহাড়ে সেগুন বাগান নষ্ট করছে পানির উৎস

আজ বিশ্ব পানি দিবস

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | শুক্রবার , ২২ মার্চ, ২০২৪ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

আজ বিশ্ব পানি দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক মিঠা পানির সংকট সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনেতা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালের রিও ধরণী সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবছরের ২২ মার্চ এ দিনটি পানি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।

প্রকৃতিগতভাবে তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক এলাকার মানুষের ভূউপরিস্থ সুপেয় পানির যোগান দেয় ঝিরিঝর্নাগুলো। তবে সাম্প্রতিকসময়ে দেখা গেছে পাহাড়ের ঝিরিঝর্নায় বছরজুড়ে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকটে ভুগছেন। পাহাড়ের ঝিরিঝর্না ও পানির উৎসগুলো নষ্ট হওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রামে এককভাবে সেগুন বাগান সৃজনকে দায়ী করছেন পরিবেশকর্মী ও বন কর্মকর্তারা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, অথনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার আশায় পাহাড়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সেগুন বাগান সৃজন করে আসছেন। এতে করে কিন্তু পরিবেশ ও জলাবায়ুর ওপর ক্রমাগত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ে বনজ বৃক্ষ বা পানি সংরক্ষণে উপযোগী বৃক্ষ সৃজন না করে সেগুনের বিস্তার বাড়ায় দিনেদিনে শুষ্ক হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশপ্রতিবেশও। প্রাকৃতিক ঝিরিঝর্নাগুলোতে পানির সংকট তৈরি হওয়ায় সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন মানুষ। এতে করে রাঙামাটির সাজেক, জুরাছড়ির দুমদুম্যা, বরকল, বিলাইছড়িসহ বান্দরবানখাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবছরই পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে।

পরিবেশকর্মী অর্ক চক্রবর্তী বলেন, একটি ২ দশমিক ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য সেগুনের চারার প্রতি ৭ দিনে ২৫০ মিলি পানি প্রয়োজন। ৫ দশমিক ৫ ইঞ্চি সেগুনের চারার ৯ দিনে ১ কাপ আর একটি ১৮ ইঞ্চি সেগুনের প্রতি ২ দিনে ১ কাপ পানি লাগে। এভাবে গাছ বড় হতে হতে তার পানির চাহিদাও জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। এই সেগুন গাছে কোনো পাখিও বাসা বাধে না। বারবার বিভিন্ন সভায় সেগুন বনায়ন নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও তা শুধু বক্তব্যেই সীমিত থাকে। আঞ্চলিক দলও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমাতে পারেনি। এটা একধরনের ট্রি টেরোরিজম। পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় আরও ৫০৬০ ফুট বেশি গভীরে যাওয়ায় পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই গভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকার কারনে বিভিন্ন রোগাক্রাহয়ে বাংলাদেশে ৭৮ লক্ষা মানুষ প্রতিবছর মারা যেতে পারে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এসেছে।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সেগুন বাগান সৃজন হয়ে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাডানিডার পর বন বিভাগের উদ্যোগে সেগুনের আধিপত্য বাড়ে। তবে ক্রমাগত সেগুন বাগানে পাহাড়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ায় এই উদ্যোগ থেকে সরে এসে বন বিভাগ সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে এখন। বর্তমানে পাহাড়ে বন বিভাগের সেগুন বাগানের চেয়েও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা বেশি। বন বিভাগের অধীনে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পর্যায়ে পাহাড়ে কত পরিমাণ ভূমিতে সেগুন বাগান রয়েছে এই সংক্রান্ত তথ্য কোনো দফতর ও বন কর্মকর্তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, সেগুন কেবল পানির উৎস নষ্টের জন্যই দায়ী নয়, পাহাড়ে ভূমি ক্ষয়ের জন্য সেগুন অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে অথনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় এবং তেমন পরিচর্যা ছাড়াই কম খরচে টিকে থাকতে পারায় পাহাড়ের মানুষ সেগুন বাগানের সৃজনের দিকে ঝুঁকেছেন। এখন পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বাঁচাতে সরকারকে সেগুন সৃজনে নিরুৎসাহিত করতে হলে একটা বিশেষ প্রকল্প ও প্রণোদনার আওতায় আনা দরকার।

ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) . মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ১৮৮৯ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেগুন বাগান তৈরি শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে সেগুন গাছের বাগান করায় এখন পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক ঝিরিঝর্নার আশপাশের গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মাটিতে পানি ধারণ সক্ষমতা কমছে। ঝিরিঝর্নার আশপাশে বনজ গাছ থাকলে এসব গাছের শেকড় দিয়ে মাটি পানি চুষে নেয়। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে মাটির পানির ধারণ সক্ষমতা কমায় সারা বছর পাহাড়ের পানির উৎসগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। সেগুন পানির উৎস নষ্টের জন্য দায়ী হলেও পাহাড়ে কাঠ উৎপাদনসহ সেগুন কার্বন গ্রহনে ভূমিকা রাখে। বন বিভাগ জলবায়ু ও পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবের কারণে সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে। তবে এটি ধাপে ধাপে হবে। হঠাৎ করেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ডিএফও এবং উপবন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পাহাড়ে সেগুন গাছের একক বাগান সৃজন থেকে সরিয়ে আসতে হবে। এখন পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোও স্থানীয়ভাবে সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছেন। অনেকেই বনজ বাগান থেকে ফলজ বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়ায় পাহাড়ে দীর্ঘমেয়াদিভাবে পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে খালবিল, ঝিরিঝর্নার পানি ব্যবহার করা প্রয়োজন। পাহাড়ে পানির উৎস কমে যাওয়া নিয়ে আমাদের একটা স্টাডিও চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্ধেকে নামলো পেঁয়াজের দাম
পরবর্তী নিবন্ধভরিতে সোনার দাম বাড়ল ২,৯১৬ টাকা