পাহাড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান | রবিবার , ৫ মে, ২০২৪ at ১০:০২ পূর্বাহ্ণ

বান্দরবানে পাহাড়ের গ্রামগুলোতে তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বনাঞ্চল উজাড়, পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত জুম চাষের কারণে পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎসস্থল পাহাড়ের ছোট ছোট ঝিরিঝর্ণা, ছড়াখালগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির কষ্টে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। দূরদূরান্ত থেকে এক কলসি পানি আনতেই সময় লেগে যাচ্ছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। বাধ্য হয়ে পাহাড়িদের অনেক পরিবার পানি কিনে খাচ্ছে এবং কেনা পানিতে সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম সারছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বান্দরবানের থানচিনীলগিরি সড়কে কোরাং পাড়া, ক্রাপুং পাড়া, সিতা পাড়া, বাগান পাড়া, ম্রলং পাড়া, গেতসিমনি পাড়া, বসন্তপাড়াসহ মোট ৩৫টির অধিক পাহাড়ি গ্রাম বা পাড়া আছে। এসব পাড়ায় প্রায় পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পরিবারের বসবাস। গেতসিমনি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের অনেক নিচুতে ঝিরির শেষ প্রান্তে মাটির নরম অংশে পাঁচছয় ফুট গভীর গর্ত খোড়া খাদে মাটি ভেদ করে অল্প অল্প করে পানি পড়ছে। গর্তের ভেতরে ঢুকে স্থানীয়রা পালা করে পাড়ার মোট ৭৫টি পরিবারের সবাই সংগ্রহ করছেন সেই পানি।

পাড়াবাসী জানান, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের গ্রাম বা পাড়াগুলো পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় পাড়া থেকে প্রায় আটশ থেকে দেড় হাজার ফুট নিচে নামলে ছোট ঝিরি বা ঝরনার দেখা মেলে। ঝিরিগুলোতে এখন পানি নেই বললেই চলে। তবুও পানির উৎসস্থলগুলোর ওপর ভরসা করে জীবন কাটছে তাদের। পাহাড়গুলোতে আগের মতো বড়বড় গাছ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাথর না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ছোট ছোট ঝিরিঝরনাগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।

চিম্বুক এলাকার ব্যবসায়ী রেং রোয়াং ম্রো বলেন, বান্দরবানথানচি সড়কের আশপাশে ছোট ছোট বাজারগুলোতে যারা দোকান করেন, তারা সকলেই পানি কিনে ব্যবহার করছেন। কিন্তু পাড়াতে বসবাসকারী মানুষদের পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তীব্র তাপদাহে পাহাড়ে মানুষের জীবনযাপনে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র পানি সংকট পাহাড়িদের জীবনযাপন আরও দুর্বিষহ করে তোলেছে।

পাড়াবাসী লিং কিয়াম ও চিংহ্লাও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠে। পাহাড়িদের খাবারের চাইতে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চরম পর্যায়ে। পাড়ার নারীরা প্রতিদিন পাড়া থেকে প্রায় আটশ থেকে দেড় হাজার ফুট নিচে নেমে খাবার পানি, রান্না ও সংসারের কাজের পানি সংগ্রহ করেন ছোটবড় বিভিন্ন পাত্রে। দুইচার দিনে একবার অল্প পানি দিয়ে গোসল করতে হয় কোনোরকমে।

এদিকে সংকটের খবরে স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর উদ্যোগে জেলা সদরের ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় থানচি সড়কের কয়েকটি গ্রামে বিতরণ করেছে। বিশুদ্ধ পানি বিতরণের অন্যতম উদ্যোক্তা সাংবাদিক বাটিং মারমা জানান, শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে গ্রামগুলোতে পানির সংকট নিয়ে দেখা দেয়। পেশাগত কাজে গিয়ে পানি সমস্যার কথা জানতে পেরে মানবিক কারণে গত দুই বছর ধরে চিম্বুকনীলগিরি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করে আসছি। এ বছরও আমরা দুইতিনজন মিলে পানি বিতরণের কাজ শুরু করেছি। পরে জেলা রেড ক্রিসেন্ট ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস ৫ লিটারের ১০০টি পানির জার দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।

গ্যালেঙ্গা ইউনিয়নের সদস্য রেংওয়াই ম্রো জানান, পাহাড়ি নারীদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে হাজার ফুট পাহাড়ের নিচের ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাও পর্যাপ্ত নয়, দেড়দুই ঘণ্টার চেষ্টায় দুয়েক কলসি পানি আনতে পারে। পানির সংকট দিনদিন আরও তীব্র হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই চরম আকারে পৌঁছাচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে জনগোষ্ঠীদের।

পানির সংকটের বিষয়টি নিশ্চিত করে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে জানান, সংকট নিরসনে চিম্বুক পাহাড়ে পানি বিতরণের খবর পেয়েছি। তাদের কাজে সহযোগিতার অংশ হিসেবে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের পক্ষ থেকে ১০ লিটারের একশটি জার দিয়েছি। তিনি বলেন, জেলায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বান্দরবান সদর ও লামা পৌরসভায় এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আরও দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সুপেয় পানির সংকট কমে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখননের অভাবে মৃত ১০ বড় খাল
পরবর্তী নিবন্ধপেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলল ভারত