পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় উদ্ভূত পরিস্থিতি ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে আশঙ্কা করে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে সেনাবাহিনী। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় অন্তত ৪ জনের মৃত্যুর পর খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও জেলা সদর এবং রাঙ্গামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার মধ্যে গতকাল শুক্রবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর–আইএসপিআর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কথা বলা হয়।
এই বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার সূত্রপাত এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাহাড়ি সংগঠনের নেতাকর্মীদের গোলাগুলির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এসব বর্ণনা তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তির শেষ অনুচ্ছেদে লেখা হয়, উপরোক্ত ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে। অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।
যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে এতে বলা হয়, তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
আইএসপিআরের বর্ণনায় সংঘাতের শুরু : ‘তিন পার্বত্য জেলাসমূহে উচ্ছৃক্সখল জনসাধারণের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ প্রসঙ্গে’ শিরোনামে সংঘাতের সূত্রপাত বিষয়ে বলা হয়, গত বুধবার খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় উচ্ছৃক্সখল জনতার পিটুনিতে মো. মামুন নামে এক যুবক নিহত হয়। সদর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন বিকেলে দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফের (মূল) কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের উপর হামলা করে ও ২০–৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে।
এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে বলে আইএসপিআরের ভাষ্য। সংঘর্ষ চলাকালে দুই পক্ষের ৬ জন আহত হলে তাদেরকে চিকিৎসার জন্য দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানোর কথা জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর টহল দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ফায়ার ব্রিগেড ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় আগুন নেভায়।
এসব ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি ও আশেপাশের এলাকাসমূহে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়, সেই সাথে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ক্রমেই পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাকর করে তোলে।
আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিসির সভাপতিত্বে জরুরি ভার্চুয়াল সভায় বসার কথা জানিয়ে আইএসপিআর লিখেছে, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িসহ সব উপজেলায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর যৌথ টহল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সব পক্ষকে সহিংস কার্যকলাপ হতে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে বলা হয়।
রাতের গোলাগুলির বর্ণনা : বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি শহরে গুলির যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেটি নিয়েও বক্তব্য তুলে ধরা হয় আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে। এতে লেখা হয়, একটি টহল দল রাত সাড়ে ১০টার দিকে মুমূর্ষু এক রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। এই গোলাগুলির ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হওয়ার কথাও তুলে ধরা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এতে আরও লেখা হয়, একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় উচ্ছৃক্সখল জনসাধারণ কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের উপর হামলা ও লাঠিপেটা করে। সেই সাথে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসে ভাঙচুর করে।
রাঙামাটিতে সংঘাত : খাগড়াছড়ির সংঘাতের জেরে গতকাল রাঙামাটিতেও সহিংসতার বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরে আইএসপিআর। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়, সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি–পিসিজেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে রাঙামাটি জিমনেশিয়াম এলাকায় সমবেত হয়। সেখানে ৮০০ থেকে এক হাজার উত্তেজিত জনসাধারণ একটি মিছিল বের করে জানিয়ে আইএসপিআর লিখেছে, (মিছিলটি) বনরুপা এলাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং বনরুপা বাজার মসজিদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল এবং বেশ কিছু দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে করে উভয় পক্ষের বেশ কিছু লোকজন আহত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।