কদিন আগেই প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের আগমন ঘটেছে। ফেলা আসা বসন্তে ঝরে গেছে শিমুল, পলাশ। ফাইশ্যা উদালের ফুল ঝরে গিয়ে এখন থোকায় থোকায় ফলের সম্ভাষণ। গ্রীষ্মের ফুল কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল, লাল সোনাইল এখনো পরিপূর্ণভাবে পেখম মেলেনি। পাতা ঝরার সময় পেরিয়ে নবপত্র–পল্লবে মুখরিত বিভিন্ন বৃক্ষ। তবে গ্রীষ্মে ফুলের দূত জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু’র চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছড়ানোর আগে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে রাজত্ব করছে শ্বেত কুরচি ফুল। রঙ সাদা। সুতীব্র ঘ্রাণ। মোহনীয় এ গন্ধে কুরচির পাশে হেঁটে যাওয়া পথিক থমকে দাঁড়ায়। ফুলের গন্ধে বিভোর হচ্ছে নির্সগপ্রেমীরা।
ফুল হিসেবে কৃষ্ণচূড়া, জারুলের মতো কদর না থাকলেও পাহাড়ে সাদা পাঁপড়ির সুবাস ছড়াচ্ছে কুরচি। এ ফুল বাংলা সাহিত্যে করে নিয়েছে এক স্বতন্ত্র স্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলের সৌন্দর্য ও প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে তাঁর কবিতায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বনবাণী কাব্যগ্রন্থে ‘কুরচি’ শিরোনামে কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল। সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত।’ কবিতায় তিনি কুরচি ফুলকে সমাজের অবহেলিত সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।’
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা কুরচি ফুলের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে ‘কুরচি তোমার লাগি’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থে তিনি কুরচি ফুলের প্রকৃতিগত ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি পথে পথে সাদা কুরচি ফুল ফুটেছে। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ি–দীঘিনালা সড়ক, রিছাং ঝরনা, মাটিরাঙা, পানছড়িসহ বিভিন্ন পাহাড়ি পথের বাঁকে কুরচির উপস্থিতি দেখা গেছে। যেসব পাহাড় জুম চাষের জন্য দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়নি। সেখানে বিভিন্ন বুনো গাছের ভিড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কুরচি। সবুজ পাহাড়ে সাদা ফুল কুরচি যেন পেখম মেলেছে। সড়কের পাশের কুরচি গাছগুলো আঁকারে বেশ ছোট। তবে প্রতিটি গাছে ফুল ফুটে আছে। বড় কুরচি গাছ দেখা গেছে খাগড়াছড়ি আদালত ভবনের সামনে। উচ্ছতায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট। পুরো গাছে যেন পাতার চেয়ে বেশি ফুল ফুটেছে। বিকেল বা সন্ধ্যার পর কোলাহলমুক্ত আদালত চত্বরে সৌরভ ছড়ায় কুরচি। গ্রীষ্মের হালকা বা মাঝারি বৃষ্টির পর শ্বেত কুরচি আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠে। ফুলের পাঁপড়িতে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা তাকে আরো বেশি স্নিগ্ধ করে তোলে। বৃষ্টির পর ঝরে যাওয়া ফুলে ধবধবে সাদা হয়ে উঠে কুরচি তলা।
পাহাড়ের কুরচিসহ বিভিন্ন ফুল নিয়ে কষ্টের কথা জানালেন হিল অর্কিড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাথোয়াই মারমা। তিনি বলেন, নির্বিচারে পাহাড়ে আগুন দেয়া এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফুলের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। এতে কুরচি, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু অনেক গাছই কাটা পড়ে। শহরের ভেতরের কুরচি রয়েছে হাতে গোনা। তবে শহর থেকে বের হলে পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে কুরচি ফুলের সৌন্দর্য দেখা যায়। এটির ওষুধিগুণও রয়েছে। পাতা আর বাকল আমাশয় নিরময়ে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাহাড় জুড়ে এখন কুরচির মুগ্ধতা।
পাহাড়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বায়োডাইভার্সিট কনজারভেশন সোসাইটি অব সিএইচটি সংগঠক প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, পাহাড়ে এই সময়ে শ্বেত কুরচি দেখা যায়। এটি মূলত পাহাড়ি এলাকার ফুল। কুরচি গাছ কাটার পরও শেকড় থেকে নতুন চারা জন্মায় এবং ফুল ফুটে। কুরচির তীব্র ঘ্রাণ মোহনীয়। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটির বিভিন্ন সড়কে এটি দেখা গেছে এবং সংখ্যায় বেশ রয়েছে। এখন কুরচি ফুলের সময়।