উঁচু–নিঁচু আর আঁকা–বাঁকা পাহাড়ি পথ, দুদিকে অসংখ্য সবুজ পাহাড়। দূর পাহাড়ি গ্রাম দেখে যেনো চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনই নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘেরা পাহাড়ি পথ বেয়ে যেতে হয় পার্বত্য জেলাগুলোতে।
পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া, দুর্গম পাহাড়ি কন্যাদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার পাহাড়ি কিছু বন্ধুদের জন্য।
পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ের পথ বেয়ে দূরে বহুদূরে গভীর এলাকাগুলোতে গেলে দেখা মেলে পরিশ্রমী অনেক নারীদের। যারা সংসারের সকল কাজ সেরে, বাইরের কাজেও পারদর্শী। যেখানে জুমচাষ, উঁচুনিচু টিলা বেয়ে মাথায় হাঁড়ি, পিঠে শিশু, কোমরে কলসি, হাতেও কিছু না কিছু নিয়ে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে জল নিয়ে ওঠে। এইসব দেখে ভাবি এরা কী না পারে! বড় বড় গাছ কেটে রাখে উনুনে দেবার জন্য। এদের সারাদিনের খাটুনি দেখে ভাবি, এইসব সমতলের পুরুষের পক্ষেও সম্ভব হবে না।
তারা সাহসী ও নিজেদের লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় সংগ্রামী। তাদের কথা, স্কুলে যাওয়াটা যেন তাদের জন্য দূর–দুরান্তের ভ্রমণের মতো। বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে পাহাড়ি রাস্তা, ঘন বন আর নদী পাড়ি দিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে যেসব বন পাড়ি দিতে হয় সেখানে বিভিন্ন হিংস্র প্রাণি বাস করে। তবুও ভয় আর ক্লান্তি ছুঁতে পারে না এই কিশোরীদের। দিনের পর দিন এই কঠিন ভ্রমণটাকেই সঙ্গী করে নিয়েছে তারা।
এই কন্যাদের অদম্য ইচ্ছায় আজ অনেকে লেখাপড়া করে ভালো কাজে যোগদান করছে। কেউবা বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেছে। যারা সুযোগ পেয়েছে তারা সকলেই কোন না কোন কাজ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছে।
পত্রিকায় দেখতে পেলাম নুখিংসাইরের কথা।
নুখিংই প্রথম কোনো পাহাড়ি কন্যা বিজিবি‘র ট্রেনিং সেন্টারে নারীদের মধ্যে সেরাদের সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। পাহাড়িদের গর্ব আর নতুন বছরের পাওয়া সেরা উপহার এটা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে তার হাতে তুলে দেন এই পুরস্কার।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন তারাছা। সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতো নুখিংসাই মারমা। কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও পড়াশোনা বন্ধ করেননি তার বাবা–মা। সীমান্তে বাড়ি হওয়ায় সে ছোটবেলা থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি)খুব কাছ থেকে দেখেছে। সেই শৈশবে তার স্বপ্নের বিজ রোপণ করেছে এমন হওয়ার ভাবনায়।
দুর্গম পাহাড়ে কৃষক পরিবারের মেয়ে হয়েও কীভাবে এতদূর এলো নুখিং? তার গল্পে সে বলেছে,
বাসা বান্দরবানের তারাছায়। পাহাড়ি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করায় মেয়ে হয়ে পড়ালেখা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। বাড়ি থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে। কোচিং–প্রাইভেটও ছিল না। কিন্তু শৈশব থেকেই বিজিবির প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল। সে বান্দরবান কালেক্টরেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। পরে বিজিবিতে সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ শুরু করে।
নুখিংসাই মার্মা বলে, চ্যালেঞ্জিং এ পেশায় দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা। সীমান্ত এলাকায় পুরুষ সহকর্মীর পাশাপাশি সীমান্ত পাহারা দেবো।
পুরুষ সদস্যরা বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে কাজ করলে নারীরা কেন নয়। সেই থেকে নারী সদস্য হিসেবে বিজিবিতে যোগদানের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ পেলো।
বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো।
আমাদের গ্রামের মেয়েরা খুব বেশি শিক্ষিত না। তারা খুব বেশি পড়ালেখাও করতে পারে না। স্কুলজীবন থেকেই বিয়ে হয়ে যায় বেশিরভাগ মেয়ের। আমি বিজিবিতে যোগদানের পর গ্রামের মানুষ অনেক খুশি। আমি তাদের কাছে একজন গর্ব। আমার দেখাদেখি যেন পাহাড়ি গ্রামের সব মেয়েরা চ্যালেঞ্জ নিতে শেখে এবং পড়ালেখা শেষ করে কর্মে যোগ দেয়।
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট নুখিংসাই। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। বিজিবিতে আসার পেছনে পরিবারের সবার সাপোর্ট ছিল। মা–বাবা অনেক কষ্ট করে বান্দরবান শহরে এনে পড়াশোনা করিয়েছেন।
বাবা–মায়ের অনুপ্রেরণায় নারী সৈনিক হিসেবে নুখিংসাই পড়াশোনা চালিয়ে ঠিকই যোগ দেয় স্বপ্নের পেশায়। বিজিবিতে যোগদানের পর টানা ছয় মাস হাড়ভাঙা ট্রেনিং সম্পন্ন করে। বিজিবির ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের নারী সৈনিক হিসেবে সমাপনী কুচকাওয়াজে ৪৬ জন নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছে নুখিংসাই। আদিবাসীদের মধ্যে বিজিবিতে প্রথমবার শ্রেষ্ঠ নুখিংসাই মারমা।
পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের মেয়ে নুখিংরের মনোবল আর সাহস দুটিই তাঁর পাহাড়চূড়ার মতোই উঁচু।
এক সময় বাহিনীটিতে নারী সদস্য না থাকলেও এখন সরাসরি অস্ত্র হাতে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন তারা। শুধু সংসারই নয়, তারা যে শক্ত হাতে নিজের দেশকেও সামলাতে পারেন এর প্রমাণ এসব নারী সীমান্তরক্ষীরা। তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক তরুণী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে যোগ দিতে আগ্রহী হচ্ছেন।
বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজে সর্বশেষ মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের ৬৯৫ জন সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৪৬ জন নারী। এই নারী সদস্যদের মধ্যে শারীরিক কসরতে প্রথম হয়েছেন আদিবাসী এই তরুণী নুখিংসাই মার্মা।
নুখিংসাই বলেছেন, বিজিবিতে ট্রেনিং পর্যন্ত আসতে পেরে আনন্দ এবং ভয় দুটোই কাজ করেছিল। মনে মনে সংকল্প করেছিলাম যে কোনোভাবে হোক ট্রেনিং শেষ করে বাবা–মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। সবাই জানেন ট্রেনিং মানে কষ্ট, কিন্তু ট্রেনিংকে কষ্ট না ভেবে, আমি আনন্দ নিয়েই করেছি। ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষকেরা খুবই আন্তরিক ছিলেন।
নুখিংসাই, তোমার সর্বাত্বক চেষ্টায়, মনের শক্তিতে তুমি আজ সেরাদের সেরা নারী সৈনিক হতে পেরেছ । এই শুধু পাহাড়ের গর্ব নয়, সকল নারীদেরও গর্ব। তোমাকে সাহসী হতে দেখে তোমার পথ অনুসরণ করবে তোমারই সহযাত্রীরা।
তোমার জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল, নুখিংসাই।