‘বিতর্কিত’ দশ তলা ভবনটি বাঁচাতে ২শ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সড়কটির গতিপথ পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য সিডিএ বলছে, শুধু ভবনটি রক্ষা নয়, খরচ বাঁচাতেই রাস্তার গতিপথ পাল্টাতে হচ্ছে। ভবনটি ভাঙতে হলে ক্ষতি হবে অন্তত ১৫ কোটি টাকা। কিন্তু ভবন বাদ দিয়ে রাস্তাটি সামান্য কার্ভ করে ভবনের পাশ দিয়ে নিয়ে গেলে খরচ হবে ৬ কোটি টাকা। প্রায় ৯ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে ভবনটি রেখে রাস্তাটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। অনুমোদন পাওয়ার পর ভবন রেখে রাস্তা নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, নগরীর চন্দনপুরা থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বাকলিয়া এক্সেস রোড নির্মাণ করা হচ্ছে। নবাব সিরাজুদ্দৌল্লা রোড থেকে বাকলিয়া থানা পর্যন্ত (বহদ্দারহাট শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক) প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, ৬০ ফুট প্রস্থের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন লাভ করে ২০১৬ সালের আগস্টে। সিরাজুদ্দৌলা রোডের চন্দনপুরা মসজিদের বিপরীত পাশে আয়েশা খাতুন লেইন (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের বাড়ির পাশ দিয়ে) দিয়ে আড়াআড়িভাবে গিয়ে রাস্তাটি চাক্তাই খাল পার হবে। খালের উপর ৬০ ফুট চওড়া ব্রিজ থাকবে। ডিসি রোড থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে বেঁকে বগার বিল, সৈয়দ শাহ রোড অতিক্রম করে বাকলিয়া থানার পাশে গিয়ে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কে যুক্ত হওয়ার কথা।
২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে। বাকলিয়া থানার কাছ থেকে শুরু হওয়া সড়কের কাজ চলতি বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডিসি রোডে মৌসুমী আবাসিক এলাকায় সিডিএর অনুমোদন নিয়ে গড়ে ওঠা ১০ তলা একটি ভবন রাস্তাটির জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়। সিডিএর অনুমোদন নেওয়া ভবনটি ২শ ৫ কোটির টাকার প্রকল্পটিকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। ভবনটি নির্মাণ করেছে হাজী চাঁন্দমিয়া সওদাগর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ ইকবাল। বাব-ই-ইউসুফ নামের ভবনটিতে ৩৭টি বিভিন্ন সাইজের ফ্ল্যাট রয়েছে। এগুলো পৃথক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ওই সময় একসাথে আরো পাঁচটি ভবনের অনুমোদন নিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ ও বিক্রি করা হয়। ওই ভবনগুলো রাস্তার অ্যালাইমেন্টের বাইরে থাকায় সমস্যা হচ্ছে না।
এই ভবনটি কিভাবে নির্মিত হলো তা নিয়ে অনুসন্ধান হয়েছে। হয়েছে তদন্ত। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। বিভিন্ন সময় ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। ভবন মালিকরা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। সিডিএর অনুমোদন থাকায় এই ভবন ভাঙতে হলে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে সিডিএ বাধ্য। কিন্তু ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে রাস্তা হিসেবে নির্ধারিত জায়গায় ভবনটি কিভাবে অনুমোদন পেল তা রহস্য হয়ে রয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যানের কারণে উক্ত এলাকায় প্রায় দুই যুগ কোনো ভবনের প্ল্যান দেয়নি সিডিএ। হঠাৎ করে দশ তলা ভবনের অনুমোদন কিভাবে দেওয়া হলো সেই প্রশ্নের সদুত্তর মিলেনি।
ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেখা যায়, ভবন মালিককে ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হবে ১১ কোটি টাকা। এর বাইরে ভবনটি ভাঙা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক খরচ বাড়বে আরো অন্তত চার কোটি টাকা। এতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ বেড়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ভবনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এক বছর।
সর্বশেষ ভবনটির ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরীকে আহ্বায়ক এবং সিডিএর অথরাইজড অফিসার-১ মোহাম্মদ ইলিয়াসকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যের কমিটি হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জুলফিকার আহমেদ ও সিডিএর উপসচিব অমল গুহ।
এই কমিটি দীর্ঘ অনুসন্ধান করে দুটি মতামত উপস্থাপন করে। এতে বলা হয়, আলোচিত ভবনটি সিডিএ থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্মিত হলেও প্রচুর মিথ্যা তথ্য রয়েছে। তথ্যও গোপন করা হয়েছে। তিন ধাপে ভবনের অনুমোদন নেওয়া হয়। ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন, বিশেষ অনুমোদন এবং নকশা অনুমোদন। তিন ধাপেই প্রচুর তথ্য গোপন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়। বলা হয়, ভবন মালিকের পক্ষ থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে সেগুলো যাছাই বাছাই না করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মোহাম্মদ ইকবালসহ ৯ ব্যক্তি প্রথমে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন ২০১০ সালের ১৩ মে। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য সিডিএতে জমা দেওয়া নকশায় জমির দৈর্ঘ্য ১৮৭ দশমিক ১৩ মিটার এবং প্রস্থ ২২ দশমিক ৫৫ মিটার উল্লেখ করা হয়। ওই নকশাটি সিডিএ থেকে অনুমোদন দেওয়ার সময় সড়কের জন্য ৯১ বর্গমিটার ভূমি সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। নকশায় নকশাবিদ আতিকুল ইসলাম, সহকারী নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ও নগর পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষর করেন।
তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, অনুমতিপত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে অনুমোদন বাতিল করার শর্ত রয়েছে। এই শর্তের ভিত্তিতে উক্ত ভবনের অনুমোদন বাতিল করে ভবনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
অপরদিকে একই কমিটি পৃথক একটি মতামত দিয়ে বলেছে, ভবনটি ভাঙতে ১১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণসহ আনুষঙ্গিক খরচ ১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভবনটি না ভাঙলে এই অর্থ খরচ হবে না। রাস্তাটিকে সামান্য কার্ভ করে নিয়ে গেলে নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ এবং রাস্তা নির্মাণে খরচ হবে ৬ কোটি টাকার মতো। এতে অন্তত ৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এই টাকা সাশ্রয় করার জন্য ভবনটি রেখে রাস্তাটি কার্ভ করে নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভবনটি না ভেঙে রাস্তাটি কার্ভ করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। তবে এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ গতকাল বলেন, আমরা বিষয়টির সবকিছু দেখেছি। অনুসন্ধানও করেছি। আমাদের পরামর্শ এবং প্রস্তাবনা লিখিতভাবে সিডিএকে জানানো হয়েছে। এখন সিডিএ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বিস্তারিত কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেন। তবে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে সিডিএ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে জানান তিনি।