পার্সোনাল ডায়েরি : অবক্ষয়ের খণ্ডচিত্র

অনন্য কাওছার | সোমবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবী, আয়ু, সাহিত্য, চিন্তা, সবকিছুই ছোট হয়ে আসছে। দীর্ঘ হচ্ছে কেবলই মানুষের বেদনাবোধ ও দীর্ঘশ্বাস। একটা সময় মানুষের মধ্যে প্রেমপ্রীতি, সহানুভূতি, বিসর্জন দেওয়ার মনমানসিকতা বিরাজমান থাকতো। আত্মিক সম্পর্কে সুদৃঢ় বন্ধনে একতাবদ্ধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখা যেতো। স্বার্থচিন্তার বদলে পরোপকারী হয়ে উঠার প্রতিযোগিতা আলিঙ্গন করতো সর্বত্র। মনোভূমি সজীব উজ্জ্বল হয়ে উঠতো অনেকখানি গল্পজল্পে। গ্রামাঞ্চলে সরলতা প্রীতিসাধন ও সৌজন্যমূলক আড্ডা ছিল। বিপদাপদে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো বটবৃক্ষের মত। এসব এখন দেখা যায় না। কারো সঙ্গে আলাপ করাই যেন বিপদ। কেউ কাউকে সাগ্রহে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সবখানে স্বার্থের লড়াইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কে কাকে তৈলমর্দন চত্ত্বরে বসাতে পারে। এগুলোই হয়ে উঠেছে প্রধান টার্গেট। মানুষের মধ্যে বিভাজন। অনৈক্যের চোরাবালি। সম্পর্ক ভাঙনের অস্থিরতা। মোটেই কাম্য নয়। সংকীর্ণ হয়ে গেছে প্রীতিস্নেহ। কারো কাছে সময় নেই।

.

সময়ের অপচয় হচ্ছে। রিলস বা বিনোদনের জগতে মনুষ্যত্ব বিকাশের ভাটা পড়ে আছে। অসুস্থ সংস্কৃতির আধিপত্য। মেকি অভিনয় আর পারিবারিক কলহবিবাদ পর্যন্ত ইন্টারনেটে। সবাই ভীষণ উদগ্রীব। চলছে মনুষ্যত্ব উধাও হবার ট্রেনিং। সঠিক রোডে অগ্রসরমান ট্রেনে চড়ছে যারা, তারাও নেমে যাচ্ছে যত্রতত্র। মহাবিভ্রাট ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সফলতা ও মূর্খতা যেন একই সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। পার্সোনালিটি বা ক্রিয়েটিভ কাজের তোয়াক্কা করছে না কেউ। হাতে সময় নেই, তবুও চোখের সামনে হেঁটে যাচ্ছো অগণিত অখাদ্য ভোজনে ক্ষয়িত সময়। একই সঙ্গে ফুরিয়ে এসেছে মানুষের জীবন। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রান্ত। বিকারগস্ত সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশ্নবিদ্ধ তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। মানুষের চিন্তাশক্তি কমে গেছে।

.

তুলনামূলকভাবে আয়ু কমে গেছে মানুষের। একইভাবে সৃজনশীল চিন্তা ও সাহিত্যের প্রয়োজন আছে কি নেই, এগুলো ভাবার সময়ও তাদের হাতের তালুতে নেই। বইয়ের জ্ঞান থেকে একশো আটানব্বই হাত দূরবর্তী দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। পড়েন, অনেকেই পড়েন। পড়ার আনুপাতিক হারটা কমে গেছে। আজকাল জ্ঞান শূন্য মস্তিষ্কের একমাত্র শক্তি ইন্টারনেট বা সার্চইঞ্জিন। এআই মুড দখল করে নিয়েছে তাদের শূন্য মস্তিষ্ক। সাহিত্যের জ্ঞান সেটা তো অনেক দূরের ব্যাপার। যেহেতু সময়সীমা কমে গেছে সবকিছুর সেহেতু সাময়িকী পাতার জায়গা ছোট হয়ে আসা স্বাভাবিক। দীর্ঘ কবিতা বা বইয়ের দেখা মেলা বড্ড মুশকিলের। তাই মানুষের দীর্ঘশ্বাস ব্যতিত সবকিছু ছোট হয়ে আসছে।

.

বাঙালি জনজীবনে চিন্তা বা সমালোচনা কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা মুশকিল। গঠনমূলক চিন্তা ও যৌক্তিক সমালোচনা বিরলপ্রজ। শব্দবাজি ও তৈলমর্দন এখানে রমরমা চলছে। জ্ঞানসমৃদ্ধির চর্চা অবহেলিত। এরচেয়ে টিকটক, রিলস কিংবা নায়িকাদের নিতম্বের আগেপাছে দৌড়ে নিউজ তৈরি সহজতম। বাঙালির অবক্ষয়ের কালো ইতিহাস আরো দীর্ঘ হচ্ছে। এরজন্য দরকার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন। সুস্থ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের চর্চা অনিবার্য। পৃথিবী হাতের মুঠোয়, তবে সুতীক্ষ্ম জ্ঞানশক্তির উদয়ন আবশ্যক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধরেডিও : স্মৃতির তরঙ্গে ভেসে থাকা এক যুগ